সুবাহ বাংলা

মুঘল সাম্রাজ্যের মহকুমা
(বাংলা সুবাহ থেকে পুনর্নির্দেশিত)

সুবাহ বাংলা (ফার্সি: صوبه بنگاله, প্রতিবর্ণীকৃত: সূবাহ্‌ বাঙ্গালাহ্‌;) বা মুঘল বাংলা ছিল মুঘল সাম্রাজ্যের একটি সুবাহ, যা ১৬শ থেকে ১৭শ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে বর্তমানের বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, বিহারওড়িশা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। বাংলা সালতানাত ভেঙে গেলে এই সুবাহের উদ্ভব হয়, এবং সেই সময়ের বিশ্বের অন্যতম বড় এ সাম্রাজ্যটি বিলীন হয়ে যায়। মুঘলেরা বাংলার সমাজ ও সংস্কৃতির উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে। ১৮ শতকের দিকে এসে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে তাদের উত্থান ঘটে।[৪]

সুবাহ বাংলা

‍صوبه بنگاله (ফার্সি)
সুবাহ বাংলা (বাংলা)
১৫৭৬–১৭৬৫
বাংলার জাতীয় পতাকা
বাম পাশের পতাকা: মুঘল সাম্রাজ্যের সময়
ডান পাশের পতাকা: বাংলার নবাব শাসনের অধীনে
বাংলা সুবাহ এর মানচিত্র
বাংলা সুবাহ এর মানচিত্র
অবস্থামুঘল সুবাহ (১৫৭৬–১৭১৭)
স্বাধীন রাষ্ট্র (১৭১৭–১৭৫৭)
রাজধানী
প্রচলিত ভাষাফার্সি (দাপ্তরিক)

বাংলা (জনসাধারণ)

আরবি (ধর্মীয় )
ধর্ম
ইসলাম (সংখ্যাগরিষ্ঠ)
হিন্দু ধর্ম এবং অন্যান্য দক্ষিণ এশীয় ধর্ম
সরকারমুঘল সুবাহ (১৫৭৬–১৭১৭)
স্বাধীন রাষ্ট্র (১৭১৭–১৭৫৭)
বাংলার নবাব 
• প্রথম নবাব
মুর্শিদ কুলি খান
• শেষ নবাব
মির্জা মুহম্মদ সিরাজ-উদ-দৌলা
ঐতিহাসিক যুগআধুনিক যুগের শুরুতে
১৫৭৬
• পূর্ব বাংলার বারো-ভূঁইয়া ভূখণ্ডের সংযোজন
১৬১১
• বাংলার নবাব এবং মুঘলদের কাছ থেকে স্বাধীনতা
১৭১৭
১৭৪১–১৭৫১
১৭৫৭
• বিলুপ্ত
১৭৬৫
মুদ্রাটাকা, মোহর
পূর্বসূরী
উত্তরসূরী
শাহী বাংলা
বারো ভুঁইয়া
পর্তুগিজ চট্টগ্রাম
ম্রক-উ রাজ্য
বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি
ফরাসি বাংলা
ওলন্দাজ বাংলা
ডেনীয় বাংলা
বর্তমানে যার অংশবাংলাদেশ
ভারত (পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, এবং ওড়িশা)

ইউরোপবাসীরা বাংলাকে পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী বাণিজ্য দেশ হিসেবে ধরতো [৫] মুঘল বাংলাকে "প্যারাডাইস অফ নেশনস"[৬] এবং "বাংলার স্বর্ণযুগ"[৭][৮] হিসাবে বর্ণনা করে। মুঘল আমলে বিশ্বের মোট উৎপাদনের (জিডিপির) ১২ শতাংশ উৎপন্ন হত সুবাহ বাংলায়,[৯][১০][১১] যা সে সময় সমগ্র ইউরোপের জিডিপির চেয়ে বেশি ছিল।[১২] বাংলার পূর্ব অংশ টেক্সটাইল উৎপাদন এবং জাহাজ নির্মাণের মতো শিল্পে বিশ্বব্যাপী বিশিষ্ট ছিল[১৩] এবং এটি বিশ্বের রেশম এবং সুতির বস্ত্র, ইস্পাত, সল্টপিটার এবং কৃষি ও শিল্পজাতীয় পণ্যগুলির প্রধান রফতানিকারক ছিল।[১০] রাজধানী জাহাঙ্গীরনগর, আজকের আধুনিক ঢাকা, এর জনসংখ্যা ১ লাখের বেশি ছিল। অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যে, মুঘল বাংলা একটি নওয়াব-স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে আবির্ভূত হয়েছিল, বাংলার নবাবদের অধীনে এবং ইতোমধ্যে প্রোটো-শিল্পায়ন পর্যবেক্ষণ করে, এটি প্রথম শিল্প বিপ্লবে প্রত্যক্ষভাবে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিল।[১৪][১৫][১৬][১৭]

১৭৪১ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে একাধিক মারাঠা আক্রমণে মুঘল বাংলা বিধ্বস্ত হয়েছিল, যেখানে মারাঠারা প্রায় ৪০০,০০০ বেসামরিক মানুষকে হত্যা করেছিল বলে ধারণা করা হয়।[১৮][১৯][২০][২১] আক্রমণগুলির সমসাময়িক বিবরণীতে মারাঠাদের দ্বারা নারী ও শিশুদের বিরুদ্ধে গণধর্ষণ করা,[২২][২৩][২৪][২৫][২৬] এবং আক্রান্তদের অঙ্গহানি করার উল্লেখও রয়েছে,[২৭][২৮] যা বাংলার অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দেয়।[২৯][৩০] ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কর্তৃক বিজয় লাভ করার পরে সুবাহ বাংলা বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়।

ইতিহাস সম্পাদনা

আকবরবাংলা বর্ষপঞ্জীর প্রবর্তক
১৭৫৭ সালে ব্রিটিশ সৈন্য পলাশীর একটি আম বাগান নিচে বাঙালি সৈন্যদের গুলি করছে

প্রথম মুঘল সম্রাট বাবরের রাজত্বকালে বাংলা মুঘলদের অধীন হতে শুরু করে। ১৫২৯ সালে, বাবর ঘঘরার যুদ্ধের সময় শাহী বাংলার সুলতান নাসিরউদ্দিন নুসরত শাহকে পরাজিত করেন। বাবর পরবর্তীকালে বাংলার কিছু অংশ তার সাম্রাজ্যে সংযুক্ত করেন। তার পুত্র এবং উত্তরসূরি হুমায়ুন বাংলার রাজধানী গৌড় দখল করেন। সেখানে তিনি ছয় মাস অবস্থান করেছিলেন।[৩১] শের শাহ সুরির বিজয়ের কারণে পরে হুমায়ুন পারস্যে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন। শের শাহ সুরি মুঘল এবং শাহী বাংলা উভয়ের রাজত্বে ক্ষণকালের জন্য বাধাগ্রস্থ করেছিলেন।

১৫৭৬ সালে রাজমহলের যুদ্ধে বাংলার সুলতান দাউদ খান কররানীর পরাজয়ের পর, মুঘল সম্রাট আকবর মূল বারো সুবাহর একটি হিসেবে বাংলার নাম ঘোষণা করেন, যার সীমানা ছিল বিহার, ওড়িশা এবং মায়ানমার পর্যন্ত। ২৪ নভেম্বর, ১৫৮৬ এক রাজকীয় সমন দিয়ে আকবর পুরো সাম্রাজ্যে একসাথে সুবাহ প্রশাসন চালু করেন। তবে তপন রায়চৌধুরীর দৃষ্টিতে বাংলায় মুঘল শক্তির একীভূতকরণ এবং প্রদেশটির মূল নিয়ন্ত্রণ ১৫৯৪ সালে শুরু হয়েছিল।[৩২]

১৭শ শতাব্দীতে, মোগলগণ বারো জন ভূস্বামীর বিরোধিতার সম্মুখীন হন, যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন ঈসা খান। বাংলা একটি শক্তিশালী ও সমৃদ্ধ সাম্রাজ্যে পরিণত হয় এবং বহুত্ববাদী সরকারের নীতির কারণে তা শক্ত অবস্থান লাভ করে। মুঘলেরা ১৬১০ সাল থেকে ঢাকায় নতুন সাম্রাজ্যবাদী মহানগরী গড়ে তোলে, যেখানে ছিল সুবিন্যস্ত বাগান, দুর্গ, সমাধি, প্রাসাদ এবং মসজিদ।[৩৩] সম্রাট জাহাঙ্গীরের প্রতি সম্মান জানিয়ে শহরটিকে তার নামে "জাহাঙ্গীরনগর" নামকরণ করা হয়। ঢাকা মুঘল সাম্রাজ্যের বাণিজ্যিক রাজধানী হিসেবে আবির্ভূত হয়, জানা যায় সাম্রাজ্যের সর্ববৃহৎ রপ্তানি কেন্দ্র ছিল মসলিন বস্ত্রকে ঘিরে।[৩৪]

১৬৬৬ সালে চট্টগ্রামে মুঘলেরা যুদ্ধে জয় লাভ করে আরাকান রাজ্য দখল করে এবং বন্দর নগরীর নিয়ন্ত্রণ পুনরায় নিয়ে নেয়, যার নাম পরিবর্তন করে রাখা হয়েছিল ইসলামাবাদ।[৩৫] পার্বত্য চট্টগ্রামের সীমান্ত অঞ্চলে মুঘল বাংলার একটি উপরাষ্ট্র তৈরি করা হয় এবং ১৭১৩ সালে চাকমা সম্প্রদায়ের সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।[৩৬]

১৫৭৬ থেকে ১৭১৭ সাল এই সময়টাতে বাংলা মুঘল সুবেদার দ্বারা শাসিত হয়। রাজপরিবারের সদস্যগণ প্রায়ই এই পদে নিযুক্ত হতেন। যুবরাজ শাহ সুজা ছিলেন সম্রাট শাহজাহান এর পুত্র। তিনি তার ভাই আওরঙ্গজেব, দারা শিকোহমুরাদ বাকশ এর সাথে উত্তরাধিকার দন্ধের সময়কালে বাংলার মুঘল সম্রাট হিসেবে নিজের নাম ঘোষণা করেন। তিনি শেষ পর্যন্ত আওরঙ্গজেবের সৈন্যবাহিনী দ্বারা পরাজিত হয়েছিলন। সুজা আরাকানে পালিয়ে যান, যেখানে তার পরিবারের সদস্যদের ম্রাউক ইউ এর রাজার নির্দেশে হত্যা করা হয়। আওরঙ্গজেবের সময়কালে শায়েস্তা খান অত্যন্ত প্রভাবশালী একজন সুবাদার ছিলেন। একসময় বাংলার সুবেদার যুবরাজ মুহাম্মদ আজম শাহ, ১৭০৭ সালে চার মাসের জন্য মুঘল সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হোন। সুবেদার ২য় ইব্রাহীম খান ইংরেজ এবং ফরাসি বণিকদের বাংলায় বাণিজ্য করার সুযোগ দেন। শেষ সুবেদার যুবরাজ আজিম-উস-শান ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়াম, ফরাসি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে চন্দননগরে ফোর্ট অর্লেন্স এবং ওলন্দাজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে চুঁচুড়ায় দুর্গ নির্মানের অনুমতি দেন।

আজম-উস-শান এর আমলে তার প্রধানমন্ত্রী মুর্শিদকুলি খাঁ বাংলার খুব ক্ষমতাবান একজন হিসেবে উদিত হন। তিনি সাম্রাজ্যের রাজকোষের নিয়ন্ত্রণ লাভ করেন। আজম-উস-শান বিহারে চলে গেলে, ১৭১৭ সালে মুঘল আদালাত প্রধানমন্ত্রীর পদ বংশানুক্রমিক নবাবে উন্নীত করেন। খান মুর্শিদাবাদে নতুন রাজধানী গড়েন। তার বংশধরেরা নাসিরি রাজবংশ গঠন করেন। আলীবর্দী খান ১৭৪০ সালে নতুন রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেন। নবাব মূল বাংলা, বিহার এবং উড়িষ্যার এক বিশাল অংশ শাসন করেন।

বাংলার নবাবগণ সম্পাদনা

১৮ শতকে মুঘল রাজসভার প্রভাব খুব দ্রুতই শেষ হয়ে যায়, বিশেষ করে পারস্যের নাদের শাহ এবং আফগানিস্তানের আহমদ শাহ দুররানি আক্রমণের মুখে পড়ে। বাংলায় সে ব্যবস্থায় কায়িক শ্রমের জন্য কম মজুরি প্রদান করে, অভিজাতদের সম্পদ মজুদ করতে দেখা যায়।

বাংলার নবাবগণ অনেক ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তির সঙ্গে চুক্তিতে প্রবেশ করেন, এছাড়া যৌথসঙ্গ কোম্পানি যারা ব্রিটেন, হাবসবার্গ অস্ট্রিয়া, ডেনমার্ক, ফ্রান্স এবং নেদারল্যান্ডকে প্রতিনিধিত্ব করে তারাও এতে যুক্ত হয়।

মারাঠা আক্রমণ সম্পাদনা

পুনরুত্থিত হিন্দু মারাঠা সাম্রাজ্য আঠারো শতকে সমৃদ্ধ বাংলার বিরুদ্ধে নৃশংস আক্রমণ চালায়, যা বাংলার নবাবদের পতনকে আরও ত্বরান্বিত করে। বিহার দখল[১৮]পশ্চিমবঙ্গের হুগলি নদীর পূর্ব পর্যন্ত মারাঠা বাহিনী আক্রমণ চালায়।[৩৭] বাঙ্গালীদের কাছে এরা বর্গি নামে পরিচিত। তারা গ্রাম পোড়ানোর কৌশল প্রয়োগ করে এবং স্থানীয় জনগণের বিরুদ্ধে ব্যাপক গণহত্যা চালায়, যা বাংলার অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দেয়। আক্রমণগুলির সমসাময়িক বিবরণীতে মারাঠাদের দ্বারা নারী ও শিশুদের বিরুদ্ধে গণধর্ষণ করা[২২][২৩][২৪][২৫][২৬], এবং আক্রান্তদের অঙ্গহানি করার উল্লেখও রয়েছে।[২৭][২৮]

আক্রমণগুলি বাংলার অর্থনীতিকে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল, কারণ মারাঠা আক্রমণে নিহত হওয়া অনেক লোক ছিল বণিক, তাঁতি, রেশম এবং তুঁত চাষকারীর অন্তর্ভুক্ত।[৩৭] উদাহরণস্বরূপ, কাশিম বাজারে ১৭৪২ খ্রিস্টাব্দে, মারাঠারা তাঁতীদের তাঁতসহ অনেক ঘরবাড়ি পুড়িয়ে ফেলে যেখানে রেশম তৈরি করার মালামাল রাখা হতো।[১৮]

মারাঠা আগ্রাসন, বাংলার নবাব মারাঠাদেরকে বাংলা ও বিহারের চৌথা (চার ভাগের এক ভাগ) হিসাবে প্রতিবছর ১.২ মিলিয়ন টাকা শ্রদ্ধা নিবেদন করতে হতো, ফলস্বরূপ মারাঠারা আর বাংলায় আক্রমণ না করতে রাজি হয়।[৩৮] নাগপুরের রঘুজী ভোঁসলের নেতৃত্বে অভিযানগুলি ওড়িশার উপর অলিখিতভাবে মারাঠা নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছিল, যা ১৭৫২ সালে মারাঠা আধিপত্যে আনুষ্ঠানিকভাবে অন্তর্ভুক্ত হয়।[৩৯] বাংলার নবাবগণও পূর্ববর্তী বছরগুলির চৌথার বকেয়ার হিসেবে মারাঠাদের ৩.২ মিলিয়ন রুপি দিয়েছিলেন।[৪০] বাংলা ব্রিটিশদের দখল না হওয়া অবধি ১৭৫৮ সাল পর্যন্ত মারাঠাদের কাছে বাংলার নবাব এই চৌথাটি প্রদান করতেন।[৪১]

ব্রিটিশ উপনিবেশ সম্পাদনা

১৮ শতকের শেষের দিকে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এ অঞ্চলের শীর্ষস্থানীয় সামরিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়। ১৭৫৭ সালে তারা পলাশীর যুদ্ধে ফরাসি এবং সিরাজ-উদ-দৌলার মিত্র বাহিনীকে পরাজিত করে, এটি মূলত নবাবের একবার বিশ্বস্ত সেনাপতি মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতার কারণে ঘটে। নবাবের শাসনাধীন বাংলা, বিহার এবং উড়িষ্যার দখল তারা নিয়ে নেয়। ১৭৬৫ সালে বক্সারের যুদ্ধের পর মুঘল রাজসভা থেকে শুল্ক আদায়ের অধিকার পায় এবং ১৭৯৩ সালে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহের পরে আনুষ্ঠানিকভাবে ব্রিটিশ রাজ কোম্পানি আইন প্রবর্তন করলে, মুঘলদের কর্তৃত্ব শেষ হয়ে যায়।

অন্য ইউরোপীয় শক্তিগুলোও বাংলায় মুঘলদের সীমানার মাঝে ছোট ছোট বসতি গড়ে তোলে, যেমন ফরাসি ঔপনিবেশিকরা চণ্ডীগড়ে, ডেনমার্কের ঔপনিবেশিকরা শ্রীরামপুরে বসতি গড়ে তোলে।

সামরিক অভিযানসমূহ সম্পাদনা

দাউদ খান বাংলার সুবেদার মুনিম খানের নিকট হতে হতে একটি পোশাক উপহার পেয়েছিলেন

জোওো ডি ব্যারোসের মতে[৪২], ভালো গোলন্দাজ বাহিনী থাকার কারণে আরাকানত্রিপুরার চেয়ে বাংলার সেনাবাহিনীর সামরিক আধিপত্য বেশি ছিল।[৪৩] বাংলার সেনাবাহিনীর উল্লেখযোগ্য পরিমাণ কামান ছিল। বাংলা ইউরোপে বারুদ এবং শোরার (saltpeter) বড় রপ্তানিকারক ছিল।[৪৪] মুঘল সেনাবাহিনী ইদ্রাকপুর দুর্গ, সোনাকান্দা দুর্গ, হাজীগঞ্জ দুর্গ, লালবাগ দুর্গ এবং জঙ্গলবাড়ী দুর্গ সহ এই অঞ্চল জুড়ে অনেক দুর্গ তৈরি করে। মুঘলরা আরাকানি এবং পর্তুগিজ জলদস্যুদের বঙ্গোপসাগরের উত্তর-পূর্ব উপকূলীয় অঞ্চল থেকে বিতাড়িত করে। মধ্যযুগের শেষের দিকে এবং আধুনিক যুগের শুরুতে, বাংলা তার নৌবাহিনী এবং জাহাজ নির্মাণের জন্য প্রসিদ্ধ ছিল।

মুঘলদের উল্লেখযোগ্য সামরিক লড়াইয়ের তালিকে নিচে দেয়া হলঃ

যুদ্ধসালসেনাপতিশত্রুপ্রতিদ্বন্দ্বী সেনাপতিফলাফল
তুকারয়ের যুদ্ধ১৫৭৫আকবরবাংলা সালতানাতদাউদ খান কররানীমুঘল জয়ী
রাজমহলের যুদ্ধ১৫৭৬প্রথম খান জাহানবাংলা সালতানাতদাউদ খান কররানীমুঘল জয়ী
ভাতির যুদ্ধ১৫৭৬-১৬১১খান জাহান ১
শাহবাজ খান কামবোহ
রাজা মানসিংহ
বারো ভুঁইয়াঈসা খাঁ
মুসা খান
মুঘল জয়ী
আহোম-মুঘল সংঘর্ষ১৬১৫-১৬৮২কাসেম খান চিশতী
মীর জুমলা
রাম সিং ১
আহোম সাম্রাজ্যআহোম রাজবংশআহোম জয়ী
মুঘল আরাকান যুদ্ধ১৬৬৫-১৬৬৬শায়েস্তা খানমারুক-ইউ সাম্রাজ্যথিরি থুধাম্মামুঘল জয়ী
বর্ধমানের যুদ্ধ১৭৪৭আলীবর্দী খানমারাঠা সাম্রাজ্যজানোজী ভোঁসলেমুঘল জয়ী
অন্ধকূপ হত্যা১৭৫৬সিরাজ-উদ-দৌলাব্রিটিশ সাম্রাজ্যরজার ডার্কিমুঘল জয়ী
পলাশীর যুদ্ধ১৭৫৭সিরাজ-উদ-দৌলাব্রিটিশ সাম্রাজ্যরবার্ট ক্লাইভব্রিটিশ জয়ী

কৃষি সংস্কার সম্পাদনা

মুঘলরা গাঙ্গেয় ব-দ্বীপে বড় ধরনের অর্থনৈতিক উন্নয়ন প্রকল্প প্রণয়ন করে, যা জনতাত্ত্বিক বিন্যাসে রুপ নেয়।[৪৫] সরকার কৃষিজমি সম্প্রসারণ করতে উর্বর ভাটি অঞ্চলের বন বিস্তীর্ণ অঞ্চল সাফ করে ফেলে। এটি বাহিরের মানুষদের, বিশেষ করে কৃষক ও জাইগীরদের ব-দ্বীপে চাষ করতে উৎসাহিত করে। এতে গ্রামবাসীদের সর্দার হিসেবে সূফীদেরকে দায়িত্ব দেয়া হয়। সম্রাট আকবর ফলন বৃদ্ধি ও কর আদায়ের সুবিধার জন্য আধুনিক বাংলা বর্ষপঞ্জী প্রবর্তন করেন। এই অঞ্চল উপমহাদেশের মধ্যে সবচেয়ে উৎপাদনশীল অঞ্চলে পরিণত হয়।স্থানীয় সূফী-সাধকগণ ইসলামিক এবং বাঙালি সংস্কৃতির এক সমন্বয় ঘটান, যা বাঙালি মুলসিম সমাজকে আরও উন্নত করে।[৪৫]

স্থাপত্য সম্পাদনা

মুল নিবন্ধঃ মুঘল স্থাপত্য

মুঘল স্থাপত্য বাংলায় বিস্তার লাভ করতে থাকে ১৬শ, ১৭শ এবং ১৭ শতকে। ১৫৮২ সালের বগুড়ার খেরুয়া মসজিদ প্রথম দিকের অন্যতম একটি নিদর্শন।[৪৬] তারা আগের সুলতানি আমলের স্থাপত্যশৈলী প্রতিস্থাপন করে। যেটা সব চেয়ে বেশি প্রয়োগ করা হয়েছিল ঢাকায়। বুড়িগঙ্গার তীরে অবস্থিত মুঘল নগরী পূর্বের ভেনিস নামে পরিচিতি লাভ করেছিল।[৪৭] লালবাগ কেল্লা ব্যাপকভাবে বাগান, ফোয়ারা, একটি মসজিদ, একটি কবর, একটি বৈঠক খানা (দিওয়ান-ই খাস) এবং দরজাযুক্ত একটি দেয়াল দ্বারা সজ্জিত করা হয়েছিল। ঢাকার বড় কাটরা এবং ছোট কাটারা ছিল সকল ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দু। এই শহরের আরও অন্যান্য স্থাপ্যতের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, ধানমন্ডি শাহী ঈদগাহ (১৬৪০), সাত গম্বুজ মসজিদ (১৬৮০), হাজী শাহাবাজের মাজার ও মসজিদ (১৬৭৯) এবং খান মোহাম্মদ মৃধা মসজিদ (১৭০৪)।[৪৬] বাংলার নবাবগণের আমলে মুর্শিদাবাদ শহরও মুঘল স্থাপ্যতের স্বর্গে পরিণত হয়। কাটরা মসজিদ (১৭২৩) এখানকার সবচেয়ে লক্ষণীয় স্থাপত্য।

গ্রামীণ পশ্চাৎপদ অঞ্চলে দেশীয় বাঙালি ইসলামিক শৈলীর সাথে মুঘল উপাদান যুক্ত করে জাঁকজমকপুর্ন স্থাপত্য তৈরি হতে থাকে। যার মধ্যে অন্যতম চমৎকার শৈলী হচ্ছে টাঙ্গাইলের আতিয়া মসজিদ (১৬০৯)।[৪৬] বেশ কিছু অনন্য পোড়ামাটির হিন্দু মন্দির স্থাপত্য এই সময়কালে তৈরি করা হয়েছিল। এসবের মধ্যে কান্তজীর মন্দির (১৭০৪) এবং বিষ্ণুপুরের মন্দিরসমুহ (১৬০০-১৭২৯) উল্লেখযোগ্য।

শিল্প সম্পাদনা

প্রকৃত বাঙালি-মুঘল শিল্প জামদানির মসলিন কাপড়ে প্রতীয়মান হয়। জামদানি ফরাসি তাঁতিরা প্রথম তৈরি করেছিলেন। এই শিল্প বাঙালি-মুসলিম তাঁতিদের হাতে আসে জুহুলাস নামে একজনের হাত ধরে। এই শিল্প ঐতিহাসিকভাবেই ঢাকা শহরের চারপাশ দিয়ে গড়ে উঠেছিল। শহরটিতে প্রায় ৮০,০০০ তাঁতি ছিল। জামদানীতে ঐতিহ্যগতভাবেই জ্যামিতিক পুষ্পশোভিত নকশা থাকতো। এই নকশায় কখনো কখনো ইরানি কিছু কাপড়ের নকশার সাদৃশ্য পাওয়া যায়। জামদানী সকলের মন জয় করে এবং বাংলার নবাব ও দিল্লির আদালতের রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে।[৪৮][৪৯] এক ধরনের আঞ্চলিক বাঙালি মুঘল শৈলী ১৮ শতকে মুর্শিদাবাদে উন্নতি লাভ করেছিল।

জনসংখ্যার উপাত্ত সম্পাদনা

জনসংখ্যা সম্পাদনা

১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধের মাধ্যমে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাংলা জয় করার পরে ১৭৬৯ সালে বাংলার জনস্ংখ্যা ছিল ৩ কোটি যা ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের পর ব্যাপক ভাবে কমে যায়।[৫০] তখন সমগ্র ভারতের জনসংখ্যা ১৭৫০ সালে ছিল ১৯ কোটি[৫১] ( যার মধ্যে বাংলার জনসংখ্যা রয়েছে ১৬% ),যেখানে ১৭৫০ সালে এশিয়ার জনসংখ্যা অনুমান করা হয় ৫০ কোটি[৫২] ( যার মধ্যে বাংলার জনসংখ্যা রয়েছে ৬%) এবং বিশ্বের জনসংখ্যা ১৭৫০ সালে ৭৯ কোটি ছিল বলে অনুমান করা হয়[৫২] ( যার মধ্যে বাংলার জনসংখ্যা রয়েছে ৩.৮%)।

ব্রিটিশ শাসনের আগে, বাংলার রাজধানী ঢাকা শহরের জনসংখ্যা ছিল দশ লাখের লোকেরও বেশি।[৫৩]

ধর্ম সম্পাদনা

বাংলা মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ ও হিন্দু সংখ্যালঘুদের নিয়ে একটি সমৃদ্ধ প্রদেশ ছিল।[১৪] স্থানীয় সূফী নেতারা ইসলামী ও বাঙালি সংস্কৃতিচর্চা একত্রিত করেছিলেন যা বাঙালি মুসলিম সমাজকে বিকশিত করেছিল।[৫৪]

অভিবাসন সম্পাদনা

মুঘল আমলে সাফাভি সাম্রাজ্য থেকে ব্যাপকভাবে অভিবাসী বাংলায় আসতে থাকে। ফার্সি প্রশাসক ও সামরিক কমান্ডারদের বাংলায় মুঘল সরকার কর্তৃক তালিকাভুক্ত হয়।[৫৫] একটি আর্মেনী সম্প্রদায় ঢাকায় বসবাস শুরু করে এবং কাপড়ের ব্যবসায় আধিপত্য বিস্তার করে, এতে তাদের ৩.৫% শুল্ক প্রদান করতে হতো।[৫৬]

অর্থনিতি এবং ব্যবসা সম্পাদনা

১৬৬৫ সালে মুঘল বাংলায় একটি ব্যবসায়িক অঞ্চল

মুঘল সাম্রাজ্যের সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক অঞ্চল ছিল বাংলার সুবাহ। এটাকে নন্দকানন হিসেবে বর্ণনা করা হতো। অভ্যন্তরীণ সম্পদের অর্ধেকই উৎপাদন হতো এই অঞ্চল থেকে। এই অঞ্চল থেকে শস্য, সুতি মুসলিন ও সিল্ক, মদ ও ওয়াইন, লবণ, অলংকার, ফল, ধাতু এবং মুক্তা রফতানি করা হতো। ১৭ এবং ১৮ শতকে ইউরোপিয়ান কোম্পানিগুলো মুঘল বাংলায় অনেক ব্যবসায়িক খাত তৈরি করে। ঢাকা মুঘল বাংলার সবচেয়ে বড় শহর এবং বাণিজ্যিক রাজধানী ছিল। চট্টগ্রাম ছিল সবচেয়ে বড় বন্দর নগরী। উপকূলবর্তী বাণিজ্যিক অঞ্চল আরাকান, অযোধ্যা, বালেশ্বর, আচেহ, জহর, বান্তাম, মাকাসসার, শ্রীলঙ্কা, বন্দর আব্বাস, মক্কা, জেদ্দা, বসরা, আদিন, মাস্কাট, মখা এবং মালদ্বীপ এর সাথে যোগাযোগ ছিল।[৫৭][৫৮][৫৯]

১৮শ শতকের বাংলায় মজুরি এবং জীবনযাত্রার মান ব্রিটেনের তুলনায় বেশি ছিল, যেখানে ব্রিটেনের জীবনযাত্রার মান ইউরোপে সর্বোচ্চ ছিল।[৬০]

কৃষি সংস্কার সম্পাদনা

মুঘলরা বাংলার বদ্বীপকে কেন্দ্র করে একটি বিশাল অর্থনৈতিক উন্নয়ন প্রকল্প চালু করেছিল যা তার জনসংখ্যার বিন্যাস বজায় রাখে। সরকার কৃষিজমি সম্প্রসারণের জন্য উর্বর ভাটি অঞ্চলে বিস্তীর্ণ বনভূমি সাফ করে। তারা কৃষকজায়গিরদার সহ জনবসতিদেরকে এই বদ্বীপে বসতি স্থাপনের জন্য উৎসাহিত করে। সুফীদেরকে গ্রামের অধ্যক্ষ বা প্রধান হিসাবে নিয়োগ হয়। সম্রাট আকবর ফসল ও কর সংগ্রহের উন্নতির জন্য আধুনিক বাংলা ক্যালেন্ডারটিকে পুনরায় সংস্কার করেছিলেন। এই সুবাহ অঞ্চলটি উপমহাদেশের বৃহত্তম শস্য উৎপাদক হয়ে ওঠে।

আবুল ফজলের আইন-ই-আকবরী এবং কিছুটা মির্জা নাথনের বাহারিস্তান-ই-গায়েবি তে আমরা বঙ্গীয় রাজস্ব প্রশাসনের স্বল্প বিবরণ পাই।[২৩] আইন-ই-আকবরী মতে',

“প্রতি বছরের চাহিদা কিস্তিতে আট মাসের মধ্যে পরিশোধ করা হ্তো, তারা (রায়ত) নিজেরাই রাজস্ব প্রাপ্তির জন্য নির্ধারিত স্থানে মোহর ও টাকা নিয়ে আসে, কারণ এখানে সরকার এবং চাষীদের মধ্যে শস্যের বিভাজন প্রচলিত ছিল না। ফসল সর্বদা প্রচুর পরিমাণে বিদ্যমান থাকত, ফলে পরিমাপের উপর জোর দেওয়া হ্তো না এবং ফসলের প্রাক্কলন অনুসারে রাজস্ব দাবিগুলি নির্ধারণ করা হতো।”[২৩]

বাঙালি কৃষকরা ১৬০০ থেকে ১৬৫০ সালের মধ্যে লাভজনক নতুন নতুন ফসলের চাষ শুরু করে যার মধ্যে তুঁত চাষ এবং রেশম চাষের কৌশল শিখেছে ছিল। সুবাহ বাংলার বিশ্বের একটি রেশম উৎপাদনকারী অঞ্চল হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করে।[৬১]

শিল্প অর্থনীতি সম্পাদনা

মুঘল আমলে বিশ্বের মোট উৎপাদনের (জিডিপির) ১২ শতাংশ উৎপন্ন হত সুবাহ বাংলায়,[৯][১০][১১] যা সে সময় সমগ্র ইউরোপের চেয়ে জিডিপির চেয়ে বেশি ছিল।[১২] যেখানে মুঘল সাম্রাজ্যের জিডিপি ছিল বিশ্বের জিডিপির ২৫% বা এক-চতুর্থাংশ। অর্থনৈতিক ইতিহাসবিদ ইন্দ্রজিৎ রায়ের মতে, বাংলা একটি সমৃদ্ধ প্রদেশ ছিল যা টেক্সটাইল উৎপাদনজাহাজ নির্মাণের মতো শিল্পে বিশ্বব্যাপী শীর্ষস্থানীয় ছিল।[১৩]

টেক্সটাইল শিল্প সম্পাদনা

মুঘল শাসনের অধীনে, বিশ্বব্যাপী মসলিন ও রেশম ব্যবসায়ের কেন্দ্রবিন্দু ছিল বাংলা। মুঘল আমলে তুলা উৎপাদনের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রটি ছিল বাংলা, বিশেষত রাজধানী ঢাকা এর আশেপাশে অঞ্চল,এজন্য মধ্য এশিয়ার মতো দূরবর্তী বাজারগুলিতে মসলিনকে "ডাকা" বলা হত।[৫৪]

আধুনিক কালের ঢাকার বড় কাটরার একটি থ্রিডি পুনর্গঠন

প্রশাসনিক বিভাগ সম্পাদনা

১৫৮২ সালে রাজস্ব বন্দোবস্তের জন্য টোডর মল বাংলার সুবাহকে ২৪টি সরকারে (জেলা) বিভক্ত করেন, যার ১৯টি ছিল মুল বাংলায় এবং বাকি ৫টি উড়িষ্যাতে। ১৬০৭ সালে জাহাঙ্গীরের সময়কালে উড়িষ্যাকে আলাদা একটি সুবাহ করা হয়। ১৬৫৮ সালে এই ১৯ সরকার পরবর্তিতে ৬৮২টি পরগনায় বিভক্ত করা হয়, শাহ্‌ সুজা পরবর্তি রাজস্ব বন্দোবস্তের জন্য এটি করেন।[৬২] নতুন ১৫টি সরকার এবং ৩৬১টি পরগনা এতে যুক্ত হয়। ১৬৭২ সালে মুর্শিদ কুলি খান পুরো সুবাহকে ১৩টি চাকলায় বিভক্ত করেন, যা পরবর্তিতে ১৬৬০টি পরগনায় বিভক্ত করা হয়।

প্রথমে সুবাহর রাজধানী ছিল তান্ডায়। ১৫৯৫ সালের ৯ নভেম্বর, রাজমহলে নতুন রাজধানী প্রতিষ্ঠা করেন মান সিংহ ১, যিনি এর নাম দেন আকবরনগর।[৬৩] সুবাদার ইসলাম খান চিশতী ১৬১০ সালে রাজধানী রাজমহল থেকে ঢাকায় স্থানান্তরিত করেন[৬৪] এবং নাম দেয়া হয় জাহাঙ্গীরনগর। ১৬৩৯ সালে শাহ্‌ সুজা পুনরায় রাজমহলে রাজধানী স্থানান্তরিত করেন। ১৬৬০ সালে মুজ্জাম খান (মীর জুমলা) আবার রাজধানী ঢাকায় নিয়ে আসেন। ১৭০৩ সালে বাংলার দিওয়ান মুর্শিদ কুলি খান তার দপ্তর ঢাকা থেকে মকসুদাবাদে নিয়ে যান এবং পরবর্তিতে যার নাম রাখা হয় মুর্শিদাবাদ।

যেসব সরকার (জেলা) এবং পরগনা (তহশিল) বাংলার সুবাহতে ছিলঃ

সরকারপরগনা
উদম্বর (তান্ডা)৫২ পরগনা
জান্নাতবাদ৬৬ পরগনা
ফাতাহবাদ৩১ পরগনা
মাহমুদাবাদ৮৮ পরগনা
খলিফাতাবাদ৩৫ পরগনা
বকলা৪ পরগনা
পূর্ণিয়া৯ পরগনা
তাজপুর২৯ পরগনা
ঘোড়াঘাট৮৪ পরগনা
পিঞ্জারা২১ পরগনা
বারবাকাবাদ৩৮ পরগনা
বাজুহা৩২ পরগনা
সোনারগাঁও৫২ পরগনা
সিলেট৮ পরগনা
চট্টগ্রাম৭ পরগনা
সরিফাবাদ২৬ পরগনা
সুলাইমানাবাদ৩১ পরগনা
সপ্তগ্রাম৫৩ পরগনা
মান্দরন১৬ পরগনা

সরকার সম্পাদনা

১৫৭৬ থেকে ১৭১৭ সালের মাঝের সময়টাতে রাজ্য সরকার মুঘলদের নিযুক্ত একজন ভাইসরয় (সুবেদার নাজিম) দ্বারা পরিচালিত হয়। ভাইসরয় তার নিজের মন্ত্রিসভা এবং চার প্রধানমন্ত্রীদের (দেওয়ান) সাথে নিয়ে ব্যাপক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। মুল বাংলার, বিহার ও উড়িষ্যার জন্য তিন সহকারী সুবাদারের ছিলেন, যারা নায়েব নাজিম হিসেবে পরিচিত ছিলেন। বিস্তৃত জমিদারী আভিজাত্য মুঘলগণ বাংলায় প্রতিষ্ঠা করেন। অভিজাতগণ শুল্ক ও লভ্যাংশ সংগ্রহ করার জন্য নিযুক্ত ছিলেন। ভূস্বামীগণ জায়গীর উপাধি লাভ করেছিলেন। কাজি উপাধি প্রধান বিচারপতির জন্য সংরক্ষিত ছিল। মনসবদাররা মুঘল সেনাবাহিনীর প্রধান এবং ফজুদাররা ছিলেন জেনারেল। মুঘলরা আকবরের আমলে ধর্মনিরপেক্ষ বহুত্ববাদের জন্য প্রশংসিত হয়েছিলেন এবং আকবর সেসময় তার প্রবর্তিত ধর্ম দীন-ই-ইলাহির প্রচার শুরু করেন। পরবর্তিতে শাসকগণ আরও রক্ষণশীল ইসলামে জোর দেন।

১৭১৭ সালে মুঘল সরকার তাদের প্রভাবশালী সহকারী ভাইসরয় ও প্রধানমন্ত্রী মুর্শিদ কুলি খানের সাথে দ্বন্দ্বের কারণে ভাইসরয় আজিম-উস-শানকে সরিয়ে নেয়। ক্রমবর্ধমান আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের জন্য মুঘল আদালত বাংলায় বংশগত আধিপত্য অনুমোদন দেয়। ফলে খান দাপ্তরিক উপাধি নাজিম নামে পরিচিতি লাভ করে। তিনি নাসিরি রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৭৪০ সালে জিরিয়ার যুদ্ধে আলিবর্দি খান অভ্যুত্থান ঘটান এবং স্বল্পস্থায়ী আফসার রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করে। সকল বাস্তবতার প্রেক্ষিতে নাজিমগণ স্বাধীন শাসক হিসেবে কাজ করতে থাকেন। ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো নওয়াব হিসেবে তাদের প্রতি অনুগত্য প্রকাশ করেন।

সুবাহদারদের তালিকা সম্পাদনা

রাজা মানসিংহ, মুঘল বাংলার রাজপুত সুবাহদার (১৫৯৪-১৬০৬)
শায়েস্তা খাঁ, সুবাহদার (১৬৬৪-১৬৮৮)
শাহজাদা মুহাম্মদ আজম শাহ(১৬৭৮-১৬৭৯)
শাহজাদা আজিম-উস-শান (১৬৯৭-১৭১২)
ব্যক্তির নাম[৬৫]শাসনকাল
মুনিম খান খান-ই-খানান
منعم خان، خان خاناں
২৫ সেপ্টেম্বর ১৫৭৪ - ২৩ অক্টোবর ১৫৭৫
হোসেন কুলি বেগ খান জাহান ১
حسین قلی بیگ، خان جہاں اول
১৫ নভেম্বর ১৫৭৫ - ১৯ ডিসেম্বর ১৫৭৮
মুজাফফর খান তুরবারি
مظفر خان تربتی
১৫৭৯ - ১৫৮০
মির্জা আজিজ কোকা খান-ই-আজম
میرزا عزیز کوکہ،خان اعظم
১৫৮২ - ১৫৮৩
শাহবাজ খান কামবোহ
شھباز خان کمبوہ
১৫৮৩ - ১৫৮৫
সাদিক খান
صادق خان
১৫৮৫ - ১৫৮৬
ওয়াজির খান তাজিক
وزیر خان
১৫৮৬ - ১৫৮৭
সাঈদ খান
سعید خان
১৫৮৭ - ১৫৯৪
রাজা মানসিংহ
راجہ مان سنگھ
৪ জুন ১৫৯৪ - ১৬০৬
কুতুবুদিন কোকা
قطب الدین خان کوکہ
২ সেপ্টেম্বর - মে ১৬০৭
জাহাঙ্গীর কুলি বেগ
جہانگیر قلی بیگ
১৬০৭ - ১৬০৮
ইসলাম খাঁইসলাম খান চিশতী
اسلام خان چشتی
জুন ১৬০৮ - ১৬১৩
কাসিম খান চিশতি
قاسم خان چشتی
১৬১৩ - ১৬১৭
ইব্রাহীম খান ফাতেহ জং
ابراہیم خان فتح جنگ
১৬১৭ - ১৬২২
মোহাবাত খান
محابت خان
১৬২২ - ১৬২৫
মির্জা আমানুল্লাহ খান জামান ২
میرزا أمان اللہ ، خان زماں ثانی
১৬২৫
মোকাররম খান
مکرم خان
১৬২৫ - ১৬২৭
ফিদাই খান
فدای خان
১৬২৭ - ১৬২৮
কাসিম খান জুইনিকাসেম মনিজা
قاسم خان جوینی، قاسم مانیجہ
১৬২৮ - ১৬৩২
মীর মুহাম্মাদ বাকির আজম খান
میر محمد باقر، اعظم خان
১৬৩২ - ১৬৩৫
মীর আব্দুস সালাম ইসলাম খান মাশহাদি
اسلام خان مشھدی
১৬৩৫ - ১৬৩৯
সুলতান শাহ সুজা
شاہ شجاع
১৬৩৯-১৬৬০
মীর জুমলা ২
میر جملہ
মে ১৬৬০ - ৩০ মার্চ ১৬৬৩
মির্জা আবু তালিব শায়েস্তা খান ১
میرزا ابو طالب، شایستہ خان
মার্চ ১৬৬৪ - ১৬৭৬
আজম খান কোকা, ফিদাই খান ২
اعظم خان کوکہ، فدای خان ثانی
১৬৭৬ - ১৬৭৭
সুলতান মুহাম্মদ আজম শাহ আলিজাহ
محمد اعظم شاہ عالی جاہ
১৬৭৮ - ১৬৭৯
মির্জা আবু তালিব শায়েস্তা খান
میرزا ابو طالب، شایستہ خان
১৬৭৯ - ১৬৮৮
ইব্রাহীম খান ইবনে আলি মাদান খান
ابراہیم خان ابن علی مردان خان
১৬৮৮ - ১৬৯৭
সুলতান আজিম-উস-শান
عظیم الشان
১৬৯৭ - ১৭১২
১৭১২-১৭১৭ তে অন্যরা নিযুক্ত হয়েছিলেন কিন্তু প্রকাশ করা হয় নাই। সহকারী সুবেদার মুর্শিদ কুলি খান সেসময় নিয়ন্ত্রণ করেছিলেন
মুর্শিদ কুলি খান
مرشد قلی خان
১৭১৭ - ১৭২৭

নবাব নাজিমদের তালিকা সম্পাদনা

প্রতিকৃতিউপাধিগত নামব্যক্তিগত নামজন্মশাসনকালমৃত্যু
নাসিরি রাজবংশ
জাফর খান বাহাদুর নাসিরিমুর্শিদ কুলি খান১৬৬৫১৭১৭-১৭২৭৩০ জুন ১৭২৭
আলা-উদ-দিন হায়দার জংসরফরাজ খান বাহাদুর?১৭২৭-১৭২৭২৯ এপ্রিল ১৭৪০
সুজা-উদ-দৌলাসুজাউদ্দিন মুহাম্মদ খাঁআনুমানিক ১৬৬০জুলাই, ১৭২৭ – ২৬ আগস্ট ১৭৩৯২৬ আগস্ট ১৭৩৯
আলা-উদ-দিন হায়দার জংসরফরাজ খান বাহাদুর?১৩ মার্চ ১৭৩৯ - এপ্রিল ১৭৪০২৯ এপ্রিল ১৭৪০
আফসার রাজবংশ
হাসিম উদ-দৌলামোহাম্মদ আলীবর্দী খান বাহাদুর১০ মে ১৬৭১ এর আগে২৯ এপ্রিল ১৭৪০ – ৯ এপ্রিল ১৭৫৬৯ এপ্রিল ১৭৫৬
সিরাজ উদ-দৌলা মোহম্মদ সিরাজউদ্দৌলা১৭৩৩এপ্রিল ১৭৫৬ - ২ জুনে ১৭৫৭২ জুলাই ১৭৫৭

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

🔥 Top keywords: প্রধান পাতাবিশেষ:অনুসন্ধানছয় দফা আন্দোলনভারতের সাধারণ নির্বাচন, ২০২৪২০২৪ আইসিসি পুরুষ টি২০ বিশ্বকাপরবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকাজী নজরুল ইসলামভারতের প্রধানমন্ত্রীদের তালিকাবাংলাদেশশেখ মুজিবুর রহমানভারতের প্রধানমন্ত্রীনরেন্দ্র মোদীক্লিওপেট্রাভারতীয় জনতা পার্টিবাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধলোকসভাএক্স এক্স এক্স এক্স (অ্যালবাম)বাংলা প্রবাদ-প্রবচনের তালিকাইন্দিরা গান্ধীআবুল হাসান মাহমুদ আলীমহাত্মা গান্ধীআবহাওয়ারাহুল গান্ধীভারতভারতের রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলসমূহমমতা বন্দ্যোপাধ্যায়বিশ্ব পরিবেশ দিবসকুরবানীইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউনবাংলা ভাষা আন্দোলনভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসমিয়া খলিফাভূমি পরিমাপপশ্চিমবঙ্গবাংলা বাগধারার তালিকা২০২৪ কোপা আমেরিকাবেনজীর আহমেদরিশতা লাবণী সীমানামুহাম্মাদ