শায়েস্তা খাঁ

মুঘল আমলে বাংলার একজন বিখ্যাত সুবেদার বা প্রাদেশিক শাসক

শায়েস্তা খান মুঘল আমলে বাংলার একজন বিখ্যাত সুবেদার বা প্রাদেশিক শাসক ছিলেন। তার খ্যাতি মূলত বাংলার সুবাদার হিসাবে। দু'দফায় সর্বমোট ২২ বছর তিনি বাংলা শাসন করেন। তিনি সম্রাট আওরঙ্গজেবের মামা ছিলেন।[৪] প্রথমে ১৬৬৪ থেকে ১৬৭৮ সাল এবং দ্বিতীয় বার ১৬৮০ থেকে ১৬৮৮ সাল। তার শাসনামলে ঢাকার ব্যাপক উন্নতি সাধিত হয় এবং এই প্রদেশে মুঘল শাসনের শ্রেষ্ঠ সময় অতিবাহিত হয়। তার শাসনামলে টাকায় ৮ মন চাল পাওয়া যেতো। এর উল্লেখযোগ্য কীর্তিগুলির মধ্যে একটি ছিল মুঘলদের চট্টগ্রাম বিজয়। ১৬৬০ সালে তাকে মারাঠা রাজা ছত্রপতি শিবাজি মহারাজের বিরুদ্ধে সংগ্রামে অংশ নিতে পাঠানো হয়েছিল। যাইহোক, তিনি একটি আশ্চর্যজনক আক্রমণে পরাজিত হন এবং তার একটি পুত্রকে হারান। এরপরে তিনি পুনে ত্যাগ করেন এবং তাঁর শিবিরটি আওরঙ্গবাদে স্থানান্তরিত করেন। ইঙ্গ-মুঘল যুদ্ধে তিনি ইংরেজদের পরাজিত করেছিলেন।।[৫][৬]

আমির-উল-উমার
মির্জা আবু তালিব বেগ
শায়েস্তা খান
খানাদেশের ভাইসরয়
কাজের মেয়াদ
১৬৫৮–১৬৬৯
সার্বভৌম শাসকআওরঙ্গজেব
বাংলার সুবাহদার
কাজের মেয়াদ
১৬৬৪– ১৬৭৮, ১৬৮০- ১৬৮৮
সার্বভৌম শাসকআওরঙ্গজেব
পূর্বসূরীমীর জুমলা
উত্তরসূরীদ্বিতীয় ইব্রাহিম খান
ব্যক্তিগত বিবরণ
জন্মআনু. ১৬০০[১]
মৃত্যু১৬৯৪ (বয়স ৯৩–৯৪)
সন্তানBuzurg Umed Khan[২]
ইরান দুখত [৩]
পিতাআবুল আসরাফ আসাফ বেগ
আত্মীয়স্বজনজুলফিকার খান (জামাতা)

প্রারম্ভিক জীবন সম্পাদনা

মির্জা আবু তালিবের পূর্বপুরুষ পারস্য (বর্তমানে ইরান) থেকে আগত এবং মুঘল রাজপরিবারের সাথেও তার সম্পর্ক ছিল। মির্জার বাবা আবুল আসরাফ আসাফ বেগ [(আসাফ খান)-উপাধি] শায়েস্তা খাঁনের দাদা মির্জা গিয়াস বেগ ইতিমাদুদ্দৌলা দু’জনেই মুঘল সাম্রাজ্যের উজির বা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বাদশাহ শাহজাহান মির্জা আবু তালিব-কে শায়েস্তা খাঁ উপাধিতে ভূষিত করেন। এর কারণ ছিল মুঘল দরবারে তার পরিবারের অবদান ও স্বীকৃতি। শায়েস্তা খাঁ মুঘল সেনাবাহিনী ও দরবারে অনুশীলন গ্রহণ করেন এবং চাকরি করেন। ফলশ্রুতিতে তিনি ক্রমশ পদোন্নতি লাভ করতে থাকেন এবং একাধিক প্রদেশের গভর্নর হন। এছাড়াও তিনি একজন সফল সেনাপতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন। গোলকন্দার সম্রাটের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময় তিনি যুবরাজ আওরঙ্গজেবের সাথে ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন।[৭]সাম্রাজ্যে অধিষ্ঠিত হবার পর সম্রাট আওরঙ্গজেব তাকে আরো পদোন্নতি দান করে আমির-উল-উমারা বা অভিজাতদের প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেন। আওরঙ্গজেবের আপন ভাই দারা শিকোর বিরুদ্ধে কর্মসূচীর অংশ হিসেবে তিনি তাকে এ পদবি দান করেন। ১৬৬৩ খ্রিষ্টাব্দে মীর জুমলার মৃত্যুর পর শায়েস্তা খাঁ বাংলার সুবাদার পদে নিযুক্ত হন।

মারাঠাদের সাথে সংঘর্ষ সম্পাদনা

১৬৫৯ সালে আওরঙ্গজেবের মুঘল সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর, তিনি শায়েস্তা খানকে দাক্ষিণাত্যের ভাইসরয় হিসাবে প্রেরণ করেছিলেন, যাতে মুঘলরা বিজাপুরের আদিলশাহির সাথে স্বাক্ষরিত চুক্তিটি কার্যকর করতে পারে। এই চুক্তির মাধ্যমে আদিলশাহি পূর্বে আহমাদনগর সালতানাত থেকে দখল করা অঞ্চলটি মুঘলদের কাছে হস্তান্তর করেছিল।[৮] যাইহোক, এই অঞ্চলটি মারাঠা শাসক, শিবাজী দ্বারাও তীব্রভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা হয়েছিল, যিনি ১৬৫৯ সালে আদিলশাহি জেনারেল আফজল খানকে হত্যার পরে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন।[৯]

১৬৬০ খ্রিষ্টাব্দে দাক্ষিণ্যাতের শিবাজীকে পরাস্ত করার জন্য শায়েস্তা খাঁকে নিযুক্ত করেন আওরঙ্গজেব। শায়েস্তা খাঁ পুনেতে তাবু স্থাপন করেন এবং কঠোর নিরাপত্তা বেষ্টিত মহলে প্রবেশ করেন। পুনে শহরে কোন মারাঠা ব্যক্তির প্রবেশাধিকার ছিল না। একদিন একটি বিবাহ অনুষ্ঠানের জন্য উৎসব পালনের উদ্দেশ্যে বিশেষ অনুমতি গ্রহণ করে শিবাজী এবং তার বাহিনী বরপক্ষ সেজে পুনেতে প্রবেশ করে। রক্ষীদের হত্যা করার পর দেওয়াল ভেঙ্গে তারা ঘরে প্রবেশ করে। শিবাজী নিজেই শায়েস্তা খাঁর মুখোমুখি হন এবং শিবাজীর তরবারির আঘাতে তার বৃদ্ধাঙ্গুলসহ তিনটি আঙ্গুল কেঁটে যায় এবং এর পরিণামে তার সংজ্ঞা হারিয়ে যায়। শায়েস্তা খাঁকে পরবর্তীতে উদ্ধার করে একটি নিরাপদ স্থানে পৌছে দেন তার অধীনস্থ কর্মীরা। পুনের ঘটনায় বিক্ষুব্ধ হয়ে আওরঙ্গজেব শায়েস্তা খাঁকে দুরবর্তী স্থান বাংলায় প্রেরণ করেন।

আরকানদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ সম্পাদনা

শায়েস্তা খান নির্মীত ছোট কাটারা ও এর মসজিদ (১৮১৭)।
চট্টগ্রাম বিজয়
তারিখনভেম্বর ১৬৬৫- ২৭ জানুয়ারী ১৬৬৬[১০]
অবস্থান
ফলাফলমুগল বিজয়[১০]
অধিকৃত
এলাকার
পরিবর্তন
চট্টগ্রাম বাংলার সাথে যুক্ত হয়
বিবাদমান পক্ষ

বাংলা
নেদারল্যান্ডস

পর্তুগাল
আরাকান
সেনাধিপতি ও নেতৃত্ব প্রদানকারী
শায়েস্তা খান
অলি বেগ খান
মজলিস খান
বুজুর উমেদ খান
ইবনে হোসাইন
ফরহাদ খান
সন্ধা থুধ্ম্ম
শক্তি
৯৬০০+সেনা[১১]
৩০০ টি যুদ্ধ জাহাজ[১১]
৪০ টি জাহাজ[১০]
অনুমান; ১১০০+সেনা
২১৭ টি যুদ্ধ জাহাজ
৩৭৮+ ছোট নৌযান
হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতি
হালকা[১০]

বেশ কয়েকটি জাহাজ ডুবে গেছে
১৩৫টি জাহাজ আটক[১০]

বাংলায় আগমনের ফলে শায়েস্তা খাঁকে দুর পাহাড়ী বিদ্রোহী উপজাতীয়দের দমন করতে দেখা যায়। শায়েস্তা খা আরাকান রাজাকে প্রচণ্ড হুমকি হিসেবে গণ্য করেছিলেন কেননা তারা সেনা ও নৌ শক্তিতে সমৃদ্ধ ছিল। তিনি তৎক্ষণাত মুঘল নৌ-বাহিনীর উন্নয়ন শুরু করেন। এক বছরে নৌ-বহরের সংখ্যা প্রায় ৩০০ পৌছে।[১২] তিনি ডাচ ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি ও সেই সাথে পর্তুগালের সমর্থন অর্জনের জন্য কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালান। ডাচ্ সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় শায়েস্তা খাঁর সেনাপতি ইবনে হোসেন আরাকানদের দখলে থাকা সন্দ্বীপ আক্রমণে মুঘলদের নেতৃত্ব দেন।[১৩] আরাকান ও পর্তুগিজদের মধ্যস্থ দ্বন্দ্বের ফলশ্রুতিতে শায়েস্তা খাঁ এক উল্লেখযোগ্য সুবিধা লাভ করেন।

১৬৬৫ এর ডিসেম্বরে শায়েস্তা খাঁ এক গুরুত্বপূর্ণ সেনা প্রচারণা চালু করেন চট্টগ্রামের বিরুদ্ধে, চট্টগ্রাম তখন ছিল আরাকানদের রাজধানী। সেখানে সাগরে এবং পরবর্তীতে কর্ণফুলীতে প্রচণ্ড নৌ-যুদ্ধ হয়, যাতে পর্তুগিজদের সহায়তায় মুঘলরা জয় লাভ করে। যুদ্ধে হেরে গিয়ে আরাকানী নৌবাহিনীর কিছু সৈন্য পালিয়ে যায় এবং কিছু দুর্গে আশ্রয় গ্রহণ করে। কিন্তু দুর্গটি ১৬৬৬ সালের ২৬শে জানুয়ারি শায়েস্তা খাঁ দখল করেন। সেই সাথে কুচবিহারকামপূরায় মুঘল সাম্রাজ্য পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন।

বাংলার গভর্নর সম্পাদনা

আরাকানদের বিরুদ্ধে জয়ের পর তিনি কয়েক হাজার কৃষকদের মুক্তি দানের নির্দেশ দেন। গভর্নর হিসেবে তিনি ইউরোপ, দক্ষিণ পূর্ব এশীয় ও ভারতের সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন করেন। তিনি ইউরোপীয়দের সাথে ব্যবসায়িক সম্পর্ক উন্নয়নের মাধ্যমে তার অবস্থান সুসংহত করেন।

কীর্তি সম্পাদনা

শায়েস্তা খাঁ নির্মিত সাত গম্বুজ মসজিদ (১৮১৪)

শেষ সময়ে শায়েস্তা খাঁ ঢাকা ছেড়ে দিল্লিতে ফিরে যান। যাবার আগে তিনি ঢাকাকে স্থানীয় বাণিজ্য, রাজনীতি ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে যান। তার কল্যাণে ঢাকা একটি ছোট দাপ্তরিক কেন্দ্র থেকে বৃহৎ ও উন্নত শহরে পরিণত হয়। শয়েস্তা খাঁ মসজিদটি তার তৈরি একটি সুবৃহৎ কীর্তি যা তার প্রাসাদ সমতলে তৈরি করা হয়েছিল। বাংলা ও মুঘল স্থাপত্য কীর্তির মিশ্রণে তৈরি এই ঐতিহাসিক পুরাকীর্তিটি বর্তমানে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক সংরক্ষিত হয়েছে।

শায়েস্তা খাঁ নির্মিত স্থাপত্য সম্পাদনা

ঢাকার লালবাগে শায়েস্তা খাঁর সদর দপ্তর ছিল। পুরনো ঢাকার বিভিন্ন স্থানে তার নির্মিত স্থাপত্য তার স্থাপত্যপ্রীতির পরিচায়ক।

গ্রন্থপঞ্জি সম্পাদনা

  • মোগল সাম্রাজ্যের সোনালী অধ্যায়(লেখকঃ সাহদাত হুসেন খান)
  • Sir Jadunath Sarkar, History of Bengal, II (Dhaka, 1948)
  • Abdul Karim, History of Bengal, Mughal Period, I, (Rajshahi, 1992)
  • Duff, Grant, History of the Marhattas Oxford University Press, (London)

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

বহিঃসংযোগ সম্পাদনা

🔥 Top keywords: প্রধান পাতাবিশেষ:অনুসন্ধানছয় দফা আন্দোলনভারতের সাধারণ নির্বাচন, ২০২৪২০২৪ আইসিসি পুরুষ টি২০ বিশ্বকাপরবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকাজী নজরুল ইসলামভারতের প্রধানমন্ত্রীদের তালিকাবাংলাদেশশেখ মুজিবুর রহমানভারতের প্রধানমন্ত্রীনরেন্দ্র মোদীক্লিওপেট্রাভারতীয় জনতা পার্টিবাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধলোকসভাএক্স এক্স এক্স এক্স (অ্যালবাম)বাংলা প্রবাদ-প্রবচনের তালিকাইন্দিরা গান্ধীআবুল হাসান মাহমুদ আলীমহাত্মা গান্ধীআবহাওয়ারাহুল গান্ধীভারতভারতের রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলসমূহমমতা বন্দ্যোপাধ্যায়বিশ্ব পরিবেশ দিবসকুরবানীইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউনবাংলা ভাষা আন্দোলনভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসমিয়া খলিফাভূমি পরিমাপপশ্চিমবঙ্গবাংলা বাগধারার তালিকা২০২৪ কোপা আমেরিকাবেনজীর আহমেদরিশতা লাবণী সীমানামুহাম্মাদ