বাংলাদেশে সমাজতন্ত্র

বাংলাদেশে সমাজতন্ত্র অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর থেকে ভিন্ন যেখানে সকল ধরনের উৎপাদন সরকার কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হয়। জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্রধর্মনিরপেক্ষতার পাশাপাশি বাংলাদেশের মূল সংবিধানে রাষ্ট্রীয় মূলনীতির চারটি মৌলিক নীতির মধ্যে সমাজতন্ত্র অন্যতম।[১][২] এটি প্রস্তাবনাতেও উল্লেখ করা হয়েছে।[৩] "সমাজতন্ত্র"কে সংবিধানে "একটি শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার উপকরণ" হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে।[৪][৫] সংবিধান রাষ্ট্রের পাশাপাশি ব্যক্তি মালিকানায় সম্পদের মালিকানা ও সমবায়কে সমর্থন করে।[৬][৭] সংবিধান বাংলাদেশকে একটি গণপ্রজাতন্ত্র হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে এবং কৃষক ও শ্রমিকদের মুক্তি নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি দেয়[৮] এবং তাঁদের অবস্থার সুরক্ষা ও উন্নতির জন্য প্রচেষ্টা চালানোর অঙ্গীকার করে।[৯] অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক সংবিধানের মতোই, বাংলাদেশের সংবিধানও বিনামূল্য ও বাধ্যতামূলক শিক্ষার ঘোষণা দেয়।[১০]

বাংলাদেশের জাতীয় প্রতীকের চারটি তারকা সংবিধানের চারটি মৌলিক নীতির প্রতিনিধিত্ব করে: জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং গণতন্ত্র। অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক দেশের মতোই, প্রান্তে ধানের শীষ সমাজতন্ত্রের প্রতীক হিসেবে কৃষি শ্রমিকদের প্রতিনিধিত্ব করে।

স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে নবপ্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ একটি সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির আকার ধারণ করে। তবে এর ফলে একটি বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় এবং অর্থনৈতিক পশ্চাদপসরণ ঘটে। ১৯৭৫ সালে দেশের রাজনৈতিক কাঠামোকে একটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিবর্তন হয় এবং দেশে শুধুমাত্র একটি নেতৃত্বস্থানীয় রাজনৈতিক দল বিদ্যমান থেকে যায়। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর দেশ শাসনব্যবস্থার একটি পরিবর্তন দেখে এবং অবশেষে ১৯৭৯ সালে সংবিধান থেকে সমাজতন্ত্র অপসারণ করা হয় আর উদারীকরণ শুরু হয়। মুক্ত বাজার অর্থনীতি চালু করা হয়, রাষ্ট্রীয় সমবায় উচ্ছেদ করা হয় এবং ভর্তুকি প্রত্যাহার করা হয়। সংবিধানকে মূল দলিলের সাথে আরে সঙ্গতিপূর্ণ করার জন্য ২০১১ সালে "সমাজতন্ত্র" ও "সমাজতান্ত্রিক" শব্দদ্বয় পুনরায় যুক্ত করা হয়, কিন্তু দেশ একটি মুক্তবাজার মিশ্র অর্থনীতি হিসেবেই রয়ে গেছে।

ইতিহাস

সম্পাদনা

প্রারম্ভিক ইতিহাস

সম্পাদনা
১৯৫০-এর দশকে পূর্ব পাকিস্তানে মুসলিম লীগ ধ্বংসের নেতৃত্ব দিয়ে বাংলা ভাষা আন্দোলনের জন্য ব্যাপক বিক্ষোভে সমাজতান্ত্রিক দলগুলো প্রভাবশালী ভূমিকা পালন করেছিল।

দেশভাগের বাংলা অঞ্চল ছিল ব্রিটিশ ভারতে বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সহ-প্রতিষ্ঠাতা মুজফ্‌ফর আহমদের মতো বাঙালি নেতারা ভারতে সমাজতন্ত্রের পাশাপাশি সাম্যবাদ প্রবর্তন ও একীভূত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।

দেশভাগের পর নবপ্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানে কমিউনিস্ট কার্যক্রম পুনরায় সংগঠিত হয়। ১৯৪৮ সালে আধুনিক আওয়ামী লীগের পূর্বসূরি আওয়ামী মুসলিম লীগ শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা এবং জমিদার প্রথার বিলুপ্তির লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। পূর্ব পাকিস্তানের ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্ট পূর্ব পাকিস্তানে একচেটিয়া কর্তৃত্ব অর্জন করে। এর পূর্বে ১৯৫০ সালে পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি ভাষা আন্দোলনের সমর্থনে শ্রমিক ধর্মঘটে প্রধান ভূমিকা পালন করেছিল।[১১] কমিউনিস্ট পার্টি যুক্তফ্রন্টের সমর্থন নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে একটি গণতান্ত্রিক সরকার গঠন করে। ১৯৫৮ সালে পূর্ব পাকিস্তানের সরকারকে কেন্দ্রীয় সরকার বরখাস্ত করে।[১২]

সমাজতান্ত্রিক যুগ (১৯৭২–১৯৭৫)

সম্পাদনা

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতির জন্য উৎপাদনমূলক কর্মকাণ্ডে রাষ্ট্রের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি করে বাংলাদেশ সরকার কিছু সমাজতান্ত্রিক পদক্ষেপ গ্রহণ করে। সোভিয়েত অর্থনৈতিক মডেলের অধীনে একটি সমাজতান্ত্রিক জাতি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অনেক বড় ও মাঝারি আকারের এন্টারপ্রাইজ ও নাগরিক উপযোগী এন্টারপ্রাইজকে জাতীয়করণ করা হয়।[১৩][১৪] ২৬ মার্চ ১৯৭২-এ বিদেশি ব্যাংকের শাখা ব্যতীত সকল ব্যাংক ও বীমা সংস্থা জাতীয়করণ করা হয়।[১৫]

দেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি ও "জাতির পিতা" বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশে সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ প্রচার করেন। তাঁর মতে, দেশের সম্পদ বাংলাদেশের সকল মানুষের। যা উৎপাদিত হবে তাতে প্রত্যেকেরই অংশীদারিত্ব থাকবে। শোষণ বন্ধ হবে।[১৬] নতুন সংবিধানে সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারার আধিপত্য ছিল এবং তাঁর দল আওয়ামী লীগ কার্যত রাষ্ট্রের নেতৃত্বস্থানীয় দলে পরিণত হয়।

যাইহোক, এই উদ্যোগের ফলে দেশে বামপন্থী বিদ্রোহের উত্থান ঘটে এবং জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) ও পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির মতো বেশকিছু আওয়ামী লীগ-বিরোধী সংগঠন ছড়িয়ে পড়ে। বিদ্রোহ সামলানোর জন্য জাতীয় রক্ষী বাহিনী (জেআরবি) নামে একটি আধা-সামরিক বাহিনী গঠন করা হয়, যেটি শেষ পর্যন্ত বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুমখুন ও নৃশংসতার সাথে জড়িয়ে পড়ে।

অর্থনীতিতেও ধ্বংস দেখা দেয়। শুধুমাত্র কিছু ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ প্রক্রিয়ার ভিতর দিয়ে যায়নি। সরকারি ক্ষেত্র খুব দ্রুত প্রসারিত হলেও জিডিপিতে এসব প্রতিষ্ঠানের অবদান খুব একটা উল্লেখযোগ্য ছিল না।[১৭] দেশের অর্থনীতির ৮০ শতাংশ যে কৃষিক্ষেত্রের উপর নির্ভরশীল ছিল, সেই কৃষিক্ষেত্রের জাতীয়করণ না করায় এমনটি হয়েছিল।[১৮] ১৯৭৪ সালে দেশে একটি বড় দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়, যাতে ব্যবস্থাগত অব্যবস্থাপনা ও ব্যর্থতা প্রকাশ পায়।

১৯৭৫ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ক্রমবর্ধমান বিদ্রোহ এবং রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনার কারণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশে একটি সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ডাক দেন, যার নাম ছিল দ্বিতীয় বিপ্লবসংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে তাঁকে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে তিনি বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) নামে একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেন।[১৯] এটি সংসদে অনুমোদিত একমাত্র দল ছিল। একটি রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশের মাধ্যমে বাকশাল গঠনের সঙ্গে অন্যান্য সকল রাজনৈতিক দলকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়[২০] এবং বাংলাদেশ একটি নিরঙ্কুশ একদলীয় সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত হয়। দলটি দ্বিতীয় বিপ্লবের তত্ত্বের অধীনে সংস্কারের একটি অংশ হিসেবে রাষ্ট্রীয় সমাজতন্ত্রকে সমর্থন দেয়।[২১] দ্বিতীয় বিপ্লবের লক্ষ্য অর্জনের জন্য বাকশাল ছিল একমাত্র সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী পরিষদ।[২২] সরকার নাগরিক স্বাধীনতাও সীমিত করে এবং বেশিরভাগ সংবাদপত্র নিষিদ্ধ করা হয়।

ক্রমবর্ধমান বিদ্রোহ, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা এবং জেআরবি নৃশংসতা সামরিক বাহিনীতে একটি মুজিববিরোধী এবং সমাজতন্ত্রবিরোধী মনোভাব তৈরি করে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের বেশিরভাগ সদস্যকে হত্যা করা হয়। তাঁর চার ঘনিষ্ঠ মিত্র ও বিপ্লবের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গকে ঐ বছরের ৩ নভেম্বর হত্যা করা হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার সাথে সাথে বাকশাল বিলুপ্ত হয়ে যায় এবং দ্বিতীয় বিপ্লব ব্যর্থ হয়।[২৩]

সমাজতন্ত্র-পরবর্তী যুগ

সম্পাদনা

১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর নতুন সামরিক নেতারা একটি পুঁজিবাদী সমাজের বিকাশের জন্য একটি বি-মুজিবীকরণ ও উদারীকরণ কার্যক্রম চালু করে। জিয়াউর রহমান (১৯৭৫–১৯৮১) এবং হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের (১৯৮২–১৯৯০) অধীনে পরবর্তী সামরিক শাসনের বছরগুলোতে সমাজতান্ত্রিক নীতি ও বাগ্মীতা পরিত্যক্ত হয়। জিয়া দ্বিতীয় বিপ্লবের অধিকাংশ নীতি প্রত্যাহার করেন এবং বহুদলীয় প্রতিনিধিত্বমূলক ব্যবস্থা পুনরায় চালু করেন। উদারপন্থী ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলগুলো পুনরুজ্জীবিত হয়, সেইসাথে জাসদ ও অন্যান্য বিপ্লবী মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী রাজনৈতিক দলগুলিকে অভ্যুত্থান-পরবর্তী শুদ্ধি অভিযানের সময় চূর্ণ করা হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য পশ্চিম জোটের দেশগুলোর সাথে সম্পর্কও ততোদিনে উন্নত হয়।

বাংলাদেশের অর্থনীতি এই সময়ের মধ্যে একটি অ-সমাজতন্ত্রীকরণের পাশাপাশি বিকেন্দ্রীকরণ দেখে। ব্যাংকিং, টেলিযোগাযোগ, বিমান চলাচল, গণমাধ্যম ও পাটশিল্পের মতো অনেক রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানকে বেসরকারীকরণ করা হয়। বাণিজ্য উদারীকরণ ও রপ্তানি উন্নীত করা হয়। বেসরকারি এই উদ্যোগ ও বিনিয়োগকে উৎসাহিত করার লক্ষ্যে অর্থনৈতিক নীতিসমূহ, সরকারি শিল্পসমূহ বেসরকারীকরণ, বাজেটের শৃঙ্খলা পুনঃস্থাপন এবং আমদানি ব্যবস্থা উদারীকরণকে ত্বরান্বিত করা হয়।[২৪]

সমসাময়িক বাংলাদেশ

সম্পাদনা

আজ সমসাময়িক বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে উদারীকৃত অর্থনীতির মধ্যে একটি।[২৫] এটি একটি উন্নয়নশীল বাজার অর্থনীতি হিসেবে চিহ্নিত।[২৬][২৭][২৮][২৯][৩০][৩১][৩২][৩৩] আওয়ামী লীগ, যে দলটি এক সময় দেশে সমাজতন্ত্রের প্রচার করেছিল, বর্তমানে মুক্তবাজার অর্থনীতি ও বিদেশি বিনিয়োগকে উৎসাহিত করছে। ১৯৯১ সালে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উল্লেখ করেন যে সমাজতন্ত্র একটি ব্যর্থ ব্যবস্থা ছিল।[৩৪]

২০১৭ সালের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা সূচকে ১৭৮ টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১২৮ তম।[৩৫]

দলসমূহ

সম্পাদনা

নিবন্ধিত

সম্পাদনা
২০০৫ সালে একটি বিরোধীদলীয় সমাবেশে জাসদ বিক্ষোভকারীরা

অনিবন্ধিত

সম্পাদনা

আরও দেখুন

সম্পাদনা

তথ্যসূত্র

সম্পাদনা
🔥 Top keywords: প্রধান পাতাবিশেষ:অনুসন্ধান২০২৪ আইসিসি পুরুষ টি২০ বিশ্বকাপসুনেত্রাআরাফাতের দিনকুরবানীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকোকা-কোলাদ্য কোকা-কোলা কোম্পানিক্লিওপেট্রাঈদুল আযহাবাংলাদেশএক্স এক্স এক্স এক্স (অ্যালবাম)উয়েফা ইউরো ২০২৪চে গেভারাবিশ্ব রক্তদাতা দিবসরাজকুমার (২০২৪-এর চলচ্চিত্র)২০২৪ কোপা আমেরিকাকাজী নজরুল ইসলামমিয়া খলিফাইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউনবাংলা প্রবাদ-প্রবচনের তালিকাহজ্জওয়াকার-উজ-জামানআইসিসি পুরুষ টি২০ বিশ্বকাপশেখ মুজিবুর রহমানআবহাওয়াঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরসাকিব আল হাসানআর্জেন্টিনা জাতীয় ফুটবল দলবাংলা ভাষামহাত্মা গান্ধীইব্রাহিম (নবী)মুহাম্মাদবাস্তুতন্ত্রউয়েফা ইউরোপীয় চ্যাম্পিয়নশিপতুফান (২০২৪-এর চলচ্চিত্র)সেন্ট মার্টিন দ্বীপপশ্চিমবঙ্গ