উত্তর ম্যাসেডোনিয়ার ইতিহাস

ইতিহাসের বিভিন্ন দিক

এই নিবন্ধটি বর্তমান উত্তর ম্যাসেডোনিয়া অঞ্চলের ইতিহাস সম্পর্কে। বৃহত্তর ম্যাসেডোনিয়া অঞ্চলের ইতিহাস জানার জন্য দেখুন "ম্যাসেডোনিয়া অঞ্চলের ইতিহাস"

প্রাক-ইতিহাস সম্পাদনা

দেখুন "দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের প্রাচীন ইতিহাস"

প্রাচীন কাল সম্পাদনা

এই অঞ্চলের প্রাচীন উপজাতি সমূহ

প্রাচীনযুগে, এখনকার উত্তর ম্যাসাডোনিয়ার অধিকাংশ এলাকা পাওনিয়া (Paeonia) রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল, যেখানে থ্রেশিয়ান (Thracian) [১] অঞ্চল হতে উদ্ভূত পাওনিয়ান জাতি (Paeonians) বসবাস করত। এছাড়াও, এর কিছু অংশ প্রাচীন ইলিরিয়া (Illyria)[২][৩] এবং দারদানিয়া (Dardania),[৪] এর অধীন ছিলো, যেখানে বিভিন্ন ইলিরিয়ান গোত্রের বসতি ছিলো।[৫][৬] আর কিছু অংশ ছিল লেনেসিস এবং পেলাগোনিয়ার অন্তর্গত যা প্রাচীন গ্রিক মোলোসিয়ান উপজাতিদের আবাসস্থল ছিল।[৭] এই জাতিসমূহের নির্দিষ্ট করে নিজস্ব কোন প্রশাসনিক সীমানা ছিল না; তারা কখনও কখনও ম্যাসেডোনের রাজাদের অনুগত হয়ে সেখানে বাস করত এবং কখনও কখনও ছত্রভঙ্গ হয়ে সড়ে যেত।

খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীর শেষের দিকে দারিয়ুস দ্য গ্রেটের অধীনে হাখমানেশি পার্সিরা পাওনিয়ানদের পরাজিত করে, ফলে উত্তর ম্যাসেডোনিয়াকে তাদের বিশাল রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। [৮][৯][১০] পরবর্তীতে ৪৭৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে গ্রিসে দ্বিতীয় পার্সিয়ান আক্রমণে শোচনীয় পরাজয় বরণ করার পর পার্সিরা অবশেষে ইউরোপীয় অঞ্চল থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করা নেয়, যার মধ্যে বর্তমান উত্তর ম্যাসাডোনিয়াও ছিল।

৩৩৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ম্যাসেডোনের দ্বিতীয় ফিলিপ পাওনিয়ার উত্তর ও দক্ষিণাংশ সহ উত্তর ম্যাসেডোনিয়াকে তার রাজ্যে সংযুক্ত করেছিলেন, যা উভয়ই এখন উত্তর ম্যাসেডোনিয়ার অংশ।[১১] পরবর্তীতে ফিলিপের ছেলে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট এই অঞ্চলের বাকি অংশের অধিকাংশ এলাকা জয় করেছিলেন এবং শুধু দারদানিয়া বাদ দিয়ে অন্যান্য এলাকা তার সাম্রাজ্যে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। রোমানরা বেশিরভাগ প্রজাতন্ত্রসমূহকে ম্যাসেডোনিয়া প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত করেছিল, কিন্তু উত্তরাঞ্চলীয় অংশগুলি (দারদানিয়া) মিসিয়ায় পড়েছিল। ডায়োকলেটিয়ানের সময়ে, তাদের উপবিভাজন করা হয়েছিল এবং প্রজাতন্ত্রটি ম্যাসেডোনিয়া সালাতারিস এবং মিসিয়া প্রিমার মধ্যে বিভক্ত হয়েছিল। [১২] অন্যদিকে, ৫ম শতাব্দীর আগে স্লাভদের সম্পর্কে খুব কমই জানা যায়।

মধ্যযুগীয় সময় সম্পাদনা

এই সময়ে জিরেসেক লাইন দ্বারা বিভক্ত উক্ত অঞ্চলটিতে থ্রাকো-রোমান বা ইলিরো-রোমান বংশোদ্ভুত লোকজন বসবাস করত। পাশাপাশি সেখানে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের হেলেনিয় নাগরিকগণ এবং বাইজেন্টাইন গ্রীকগণ বসবাস করত। স্থানীয় থ্রাকো-ইল্লিয়ারিয়ানদের প্রাচীন ভাষাগুলি স্লাভদের আগমনের আগেই বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল এবং মধ্যযুগের শুরুর দিকে বলকানদের বারংবার বর্বর আক্রমণের কারণে তাদের সাংস্কৃতিক প্রভাব অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছিল। এর জন্য অবশ্য ক্রমবর্ধমান গ্রীক, রোমান, স্লাভ নাগরিকদেরও ভুমিকা ছিল। দক্ষিণ স্লাভিক উপজাতিগণ ৬ষ্ঠ শতাব্দীতে বর্তমান দিনের ম্যাসেডোনিয়া অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেছিল। স্লাভিক বসতিগুলিকে বাইজেন্টাইন গ্রীক ঐতিহাসিকরা "Sklavines" হিসাবে উল্লেখ করেছেন। Sklavines যোদ্ধারা বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি আক্রমণে অংশগ্রহণ করে, কখনো একা আবার কখনো বুলগার বা এভার্য দের সাহায্য নিয়ে। আনুমানিক ৬৮০ খ্রিষ্টাব্দে বুলগেরার দল কুবের খান (দানুবিয়ান বুলগেরিয়ান আসপারুখ খান এবং তিনি একই গোত্রের ছিলেন) এর নেতৃত্বে পেলাগোনিয়ান সমভূমিতে বসতি স্থাপন করে থেসালোনিকি অঞ্চলে অভিযান চালায়।

সপ্তম শতাব্দীর শেষের দিকে সম্রাট দ্বিতীয় জাস্টিনিয়ান গ্রিক উপদ্বীপের স্ক্ল্যাভিনিয়ার বিরুদ্ধে ব্যাপক অভিযান পরিচালনা করেছিলেন, যেখানে তিনি ১১০,০০০ স্লাভকে বন্দি করে তাদেরকে ক্যাপাদোকিয়াতে স্থানান্তর করেছিলেন বলে জানা যায়। সম্রাট দ্বিতীয় কনস্ট্যান্স এর সময় (যিনি স্লাভদের বিরুদ্ধেও অভিযান পরিচালনা করেছিলেন) ম্যাসেডোনিয়ার উল্লেখযোগ্য সংখ্যক স্লাভকে বন্দি করে তাদেরকে মধ্য এশিয়া মাইনরে স্থানান্তর করা হয় যেখানে তারা বাইজেন্টাইন সম্রাট এর কর্তৃত্বকে স্বীকার করতে বাধ্য হয়।

১০২০ সালে ওহরিদের আর্চবিশপের কর্তৃত্বাধীন অঞ্চল
১২৫ খ্রিস্টাব্দে ম্যাসেডোনিয়ার রোমান প্রদেশ

৮৩৬ খ্রিষ্টাব্দের পর থেকে বাইজেন্টাইন নথিসমূহে "Sklavines" নামে কোন জাতির উল্লেখ আর পাওয়া যায় না যেহেতু ম্যাসেডোনিয়া অঞ্চলে বসবাসকারী স্লাভ নাগরিকগণ প্রথম বুলগেরিয়ান সাম্রাজ্যের প্রজা হিসেবে অঙ্গীভুত হয়। মূলত স্ক্লেভাইনস এবং বুলগার দুটি স্বতন্ত্র জাতি। বুলগারগণ বুলগেরিয়ানের ডাকনাম এবং সাম্রাজ্যের নাম বজায় রাখার সময় স্লাভিক ভাষা / পরিচয়কে সম্পৃক্ত করেছিল। এই রাজ্যের উত্থানের সাথে সাথে অত্র অঞ্চলে স্ল্যাভিক প্রভাবও জোরদার হয়েছিল, যা ৮৩৭ খ্রিষ্টাব্দে সমগ্র অঞ্চলটিকে তার রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেছিল। সেইন্ট সিরিল এবং মেথডিয়াস ও থেসালোনিকি-তে জন্মগ্রহণকারী বাইজেন্টাইন গ্রীকগণ প্রথম স্লাভিক গ্লাগোলিটিক বর্ণমালা এবং ওল্ড চার্চ স্লাভনিক ভাষার প্রবর্তক ছিলেন। তারা স্লাভিক ভাষাভাষীদের মধ্যে খ্রিস্টান ধর্মেরও প্রচারক ছিলেন। মধ্যযুগীয় বুলগেরিয়ায় তাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও অর্জন বিকশিত হয়েছিল, যেখানে ৮৮৫ সালের পরে সেইন্ট ক্লেমেন্ট অব অহরিদ কে "বুলগেরিয়ান ভাষার প্রথম আর্চবিশপ" হিসেবে মনোনয়ন দেয়ার ফলশ্রুতিতে ওহরিদ শহরটি এই অঞ্চলের বাসিন্দাদের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাসনালয় কেন্দ্রে পরিণত হয়। সেইন্ট সিরিল এবং মেথডিয়াস এর অন্যতম শিষ্য সেইন্ট নাউমের সাথে মিলে তিনি ওহরিদের চারপাশে একটি বুলগেরিয়ান সাংস্কৃতিক কেন্দ্র তৈরি করেছিলেন, যেখানে গ্ল্যাগোলিটিক এবং সিরিলিক স্ক্রিপ্টে ৩,০০০ এরও বেশি শিক্ষার্থীকে শিক্ষাদান করা হয়েছিল, যাকে বর্তমানে ওহিড লিটারারি স্কুল বলা হয়।

প্রিন্স মার্কো
প্রিন্স মার্কো এর রাজত্ব

১০ম শতাব্দীর শেষভাগে, রুশ সম্রাট জার সামুইলের অধীনে বর্তমান উত্তর ম্যাসেডোনিয়ার বেশির ভাগ এলাকা প্রথম বুলগেরিয়ান সাম্রাজ্যের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। অন্যদিকে তৎকালীন বাইজেন্টাইন সম্রাট ৯৭২ সালে সাম্রাজ্যের পূর্ব অংশ (বর্তমানে বুলগেরিয়া) যার রাজধানী ছিল প্রেস্লাভ (Preslav), রুশ দের পরাজিত করে তার কব্জায় নিলেন। একটি নতুন রাজধানী প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল ওহরিদ এ, যা বুলগেরিয়ান চার্চ এর বিশপের পদ হিসেবে উন্নীত হয়েছিল। তারপর থেকে, এই বুলগেরিয়ান মডেল সার্বিকভাবে পুরো স্লাভিক সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠে। পরবর্তীতে কয়েক দশকের প্রায়শই অযৌক্তিক যুদ্ধের পর ১০১৮ সালে বুলগেরিয়া সম্পুর্নভাবে বাইজেন্টাইন শাসনের অধীনে চলে আসে। পুরো উত্তর ম্যাসেডোনিয়া বুলগেরিয়ার থিম এর অংশ হিসেবে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল [১] এবং বুলগেরিয়ান প্যাট্রিয়ার্কটাকে একটি আর্কবিশপ্রিক পদে পদাবনতি দেয়া হয়েছিল। [২]

পরবর্তীতে একজন ভ্লাক্স নেতা দব্রমির ক্রিসোস বাইজেন্টাইন সম্রাটের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল এবং ১১৯৭ সালের শরৎ এ তার বিরুদ্ধে সম্রাটের দমন অভিযান ব্যর্থ হলে সম্রাট শান্তির পথ বেছে নিয়েছিলেন এবং দব্রমির ক্রিসোস কে স্ট্রোমিকা ও প্রসেকের দুর্গ সহ স্ট্রিমন থেকে ওয়ারদারের মধ্যের অঞ্চলসমূহে তার শাসনাধিকারেরর স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। [১৩]

১৩ এবং ১৪তম শতাব্দীতে, বুলগেরিয়ান এবং সার্বিয়ান শাসনের সময়ে অত্র অঞ্চলে বাইজেন্টাইন সম্রাটের নিয়ন্ত্রণ লোপ পেয়েছিল। উদাহরণস্বরূপ, কনস্টানটিন আশেন - স্কোপের একজন সাবেক রাজ কর্মচারী ১২৫৭ থেকে ১২৭৭ সাল পর্যন্ত জার হিসেবে বুলগেরিয়া শাসন করেন। পরবর্তীতে, স্টিফান দুসান এর অধীনে স্কোপে সার্বিয়ান সাম্রাজ্যের রাজধানী হয়ে উঠে। সাম্রাজ্যের বিলুপ্তির পর এলাকাটি ছোট রাজ্যে বিভক্ত হয়ে স্থানীয় ম্রিঞ্জাভেসিভিচ ও ড্রাগাস পরিবারের সদস্যদের দ্বারা স্বাধীনভাবে শাসিত হয়। ম্রিঞ্জাভেসিভিচ পরিবার বর্তমান উত্তর ম্যাসেডোনিয়া অঞ্চলের পশ্চিমাঞ্চলের অংশ এবং ড্রাগাস পরিবার পূর্বাঞ্চলীয় অংশ শাসন করত। ম্রিঞ্জাভেসিভিচদের রাজ্যের রাজধানী ছিল প্রিলেপ। ম্রিঞ্জাভেসিভিচ পরিবার থেকে দুজন বিখ্যাত শাসক রয়েছেন - রাজা ভুকসিন ম্রিঞ্জাভেসিভিচ এবং তার পুত্র, রাজা মার্কো । রাজা মার্কো অটোমান সাম্রাজ্যের একজন সামন্ত হিসেবে রাজ্য পরিচালনা করেন এবং পরবর্তীতে রোভিনের যুদ্ধে নিহত হন।

অটোমান যুগ সম্পাদনা

১৯ শতকের শেষভাগের প্রিলেপ শহর। পিছন দিকে একটি অটোমান মিনার দেখা যাচ্ছে

১৫ শতাব্দীর প্রথমার্ধে এই অঞ্চলটি অটোমান সেনাবাহিনী কর্তৃক বিজিত হয় যা রুমেলিয়ার প্রদেশ বা আইলেট হিসাবে প্রায় ৫০০ বছর ধরে অটোমান সাম্রাজ্যের অংশ ছিল। তুর্কিতে Rumelia ( তুর্কি : Rumeli) নামের অর্থ "রোমানদের ভূমি" অর্থাৎ বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের কাছ থেকে অটোমান তুর্কীদের দ্বারা বিজিত ভূমি। [১৪] কয়েক শতাব্দী ধরে রুমেলিয়া আইলেটটি প্রশাসনিক সংস্কারের মাধ্যমে আকারে হ্রাস পেয়েছিল। উনিশ শতকে এটির পরিধি ছিল কেন্দ্রীয় আলবেনিয়া অঞ্চল এবং বর্তমান উত্তর ম্যাসেডোনিয়ার উত্তর-পশ্চিম অংশ, যার রাজধানী ছিল মানস্তির বা বর্তমান বিটোলা। [১৫] ১৮৬৭ সালে রুমেলিয়া আইলেটটি বিলুপ্ত করা হয় এবং উত্তর ম্যাসেডোনিয়া অঞ্চলটি ১৯১২ সালে অটোমান শাসনের অবসান পর্যন্ত মানস্তির ভিলায়েত প্রদেশের অংশ হয়ে ওঠে।

অটোমান শাসনের সময় এই অঞ্চলে তুর্কী সংখ্যালঘুদের বসতি উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পায়, বিশেষ করে ধর্মীয় দিক বিবেচনা করলে মুসলমানদের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়, কেউ কেউ ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলমান হয়। অটোমান শাসনের সময়, স্কোপে এবং মনস্তির ( বিটোলা ) পৃথক পৃথক অটোমান প্রদেশের (eyalets) রাজধানী ছিল। ভারডার নদির উপত্যকা, যা পরে উত্তর ম্যাসেডোনিয়ার কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল, ১৯১২ সালের প্রথম বলকান যুদ্ধের পূর্ব পর্যন্ত অটোমান সাম্রাজ্য দ্বারা শাসিত হয়েছিল। ১৮৭৮ সালে সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য ব্যতিক্রম ছিল, যখন এটি রুশো-তুর্কি যুদ্ধের পর (1877-78), অটোমান শাসন থেকে মুক্ত হয়ে বুলগেরিয়ার অংশ হয়েছিল। ১৯০৩ সালে, ইলিন্ডেন-প্রিয়ব্রাঝেনি বি্প্লবের সময় বিদ্রোহীদের দ্বারা বর্তমান উত্তর ম্যাসেডোনিয়া অঞ্চলের দক্ষিণ-পশ্চিমাংশে একটি স্বল্পকালীন ক্রুসেভ প্রজাতন্ত্র ঘোষিত হয়েছিল। অটোমান শাসনের সময়ে বেশিরভাগ নৃবিদ এবং পর্যটকগণ ম্যাসেডোনিয়ার স্লাভিক ভাষাভাষী জনগণকে বুলগেরিয়ান হিসাবে উল্লেখ করেছেন। উদাহরণস্বরূপ ১৭তম শতাব্দীর ভ্রমণকারী ইভলিয়া সেলেবি তার সিয়াহাটনামেঃ পর্যটনের বই এবং পরবর্তীতে ১৯০৪ সালে হিলমি পাশা তার অটোমান আদমশুমারী উল্লেখযোগ্য। তবে তারা মন্তব্য করেছেন যে ম্যাসেডোনিয়াতে কথিত ভাষাটি কিছুটা স্বতন্ত্র ছিল - আধুনিক পশ্চিমা বুলগেরিয়ার বুলগেরিয়ান উপভাষার উচ্চারণের কাছাকাছি "পশ্চিম বুলগেরিয়ান উপভাষা" বলে উল্লেখ করা হয়।

এমনও প্রমাণ পাওয়া যায় যে, কিছু বিশেষ ম্যাসেডোনিয়ান স্লাভ অধিবাসী, বিশেষ করে উত্তর অঞ্চলের বসবাসকারীগণ, নিজেদেরকে সার্ব বলে মনে করত, অন্যদিকে দক্ষিণ ম্যাসেডোনিয়ার আধিবাসিগণ, যাদের বেশিরভাগই স্লাভিক ভাষী ছিল, তারা গ্রীসের সাথে যোগদানের জন্য প্রবল সমর্থন দিত। যদিও ম্যাসেডোনিয়াতে বসবাসকারী স্লাভদের কে বুলগেরিয়ান হিসাবে বিভিন্ন সূত্রে উল্লেখ করা হয়েছিল, তবে কিছু পণ্ডিত মনে করেন যে মধ্যযুগীয় সময়ে জাতিগত বৈচিত্রতা আজকে আমরা যা দেখতে পাচ্ছি তার তুলনায় আরও প্রবহমান ছিল, যা ঊনবিংশ শতাব্দীর সমঝোতাভিত্তিক জাতি-রাষ্ট্রের জাতীয়তাবাদী আদর্শগুলি থেকে বোঝা যায়। [১৬][১৭]

বুলগেরিয়ান জাতীয় পুনরুজ্জীবনের সময়, ভারদা ম্যাসেডোনিয়ার অধিবাসী বহু বুলগেরিয়ান বুলগেরিয়ান সাংস্কৃতিক শিক্ষা ও বুলগেরিয় চার্চের কর্তৃত্ব সহ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান নির্মাণের সংগ্রাম সমর্থন করে।

১৯১২-১৯৪৪ সম্পাদনা

সার্বিয়া রাজ্য (1914)
নিউইলি, ট্রায়ানন এবং রাপালোর চুক্তির আগে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী ১৯১৯ সালের ইউগোস্লাভিয়ার মানচিত্র (উল্লেখ্য, এই মানচিত্রটি আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত সীমানা বা যুদ্ধবিরতি লাইনগুলিকে প্রতিফলিত করে না - এটি শুধুমাত্র প্যারিসের শান্তি সম্মেলনে কীভাবে চূড়ান্ত সীমানা দেখাবে এ বিষয়ে লন্ডন জিওগ্রাফিকাল ইনস্টিটিউটের গবেষকদের মতামতের প্রতিফলন)
ইউগোস্লাভিয়ার রাজ্যের একটি প্রদেশ ভারদার বানোভিনা এর মানচিত্র (১৯২৯-১৯৪১)

১৯১২ সালের প্রথম বলকান যুদ্ধের সময় সার্বিয়ার রাজা এই অঞ্চলটি দখল করে নেন। পরবর্তীতে যুদ্ধপরবর্তী শান্তি চুক্তি মোতাবেক সার্বিয়ার সাথে অঞ্চলটি যুক্ত হয়। এটির কোন প্রশাসনিক স্বায়ত্তশাসন ছিল না এবং এটাকে জুজনা শ্রবিজা ("দক্ষিণ সার্বিয়া") বা স্টারা শ্রবিজা ("ওল্ড সার্বিয়া") বলা হত। ১৯১৫ এবং ১৯১৮ সালের মধ্যে এলাকাটি বুলগেরিয়ার রাজা দখল করে নেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর, সার্বিয়া রাজ্য নতুন প্রতিষ্ঠিত সার্বস, ক্রোটস এবং স্লোভেনিয়ার সার্বভৌম রাজ্যের সাথে যোগ দেয়। ১৯২৯ সালে রাজত্বটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে ইউগোস্লাভিয়া রাজত্বের নামে নতুন নামকরণ করা হয়েছিল এবং যা বানোভিনা নামে প্রদেশসমূহে বিভক্ত ছিল। ভারদার বানোভিনার রাজধানী ছিল স্কোপে এবং ভারদার বানোভিনা প্রদেশটিই অবশেষে আধুনিক উত্তর ম্যাসাডোনিয়া হয়ে ওঠে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের (১৯১৪-১৯১৮) পর সার্বিয়ান ( ভারদার) ম্যাসেডোনিয়াতে বসবাসকারী স্লাভ অধিবাসীগণ দক্ষিণী সার্ব হিসাবে পরিচিত ছিল এবং তারা দক্ষিণী সার্বিয়ান উচ্চারণে কথা বলত। বুলগেরিয়ান, গ্রীক এবং রোমানিয়ান স্কুলসমূহ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, বুলগেরিয়ান পুরোহিত এবং সমস্ত অ-সার্বিয়ান শিক্ষককে বহিষ্কার করা হয়েছিল। ১৯২০ থেকে ১৯৩০ এর দশকে সার্বিয়ান সার্বভৌমত্বের নীতি বুলগেরিয়া হতে অনুপ্রবেশকারী ইন্টারনাল ম্যাসেডোনিয়ান রেভোলিউশানারী অরগানাইজেশন (আইএমআরও) কর্তৃক প্রচারিত প্রোবুলগেরিয়ান মনোভাবের সাথে সংঘর্ষ তৈরী করে, যেখানে স্থানীয় কমিউনিস্টরা স্ব-শাসনের পথকে সমর্থন করেছিল।

১৯২৫ সালে, ডি.জে. ফুটমেন, স্কোপে নিযুক্ত ব্রিটিশ ভাইস কনসাল, বৃটেনের পররাষ্ট্র দপ্তরে একটি লম্বা প্রতিবেদন দাখিল করেন। তিনি লিখেছিলেন যে "দক্ষিণ সার্বিয়ার বেশিরভাগ অধিবাসীরা হলো ম্যাসেডোনিয়ান অর্থডক্স খ্রিস্টান, যারা নৃতাত্ত্বিকভাবে সার্বদের তুলনায় বুলগেরিয়ানদের সাথে সম্পৃক্ত।" তিনি সোলোনিকা কে রাজধানী করে একটি স্বাধীন ম্যাসেডোনিয়া প্রতিষ্ঠার ব্যপারেও জনগণের আগ্রহ বিদ্যমান বলে উল্লেখ করেন।[১৮] দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, ১৯৪১ থেকে ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত ভারদার বানোভিনা অঞ্চলটি ইতালীয় শাসিত আলবেনিয়া দ্বারা (যা আলবেনিয়ান -জনসংখ্যা অধ্যুষিত পশ্চিমাঞ্চলকে দখলে নিয়ে নেয়) এবং জার্মানপন্থি বুলগেরিয়া দ্বারা (যারা অবশিষ্ট অঞ্চল দখল করেছিল) অধিকৃত এবং শাসিত হয়।

দখলদার শাসকগণ সেই প্রদেশের অধিবাসীদের মধ্যে যারা দখলদারদের শাসনের বিরুদ্ধে ছিল তাদেরকে কঠোর ভাবে দমন করেছিল। ফলশ্রুতিতে, স্থানীয়দের মধ্যে অনেকে জোসেপ ব্রোজ টিটোর নেতৃত্বাধিন কমিউনিস্ট দলের প্রতিরোধ আন্দোলনে যোগ দেন। তারপরও, ম্যাসেডোনিয়াতে প্রবেশকালে বুলগেরিয়ান সেনাবাহিনীকে বেশিরভাগ জনগোষ্ঠী ভালভাবে গ্রহণ করেছিল [১৯] এবং এই বাহিনী পরে স্থানীয় জনসংখ্যা থেকে সৈন্য নিয়োগ করতে সক্ষম হয়েছিল, যাদের সংখ্যা কিছু কিছু ব্যাটেলিয়নে মোট অংশগ্রহণকারী সৈন্যের ৪০% থেকে ৬০% ছিল।

১৯৪৪-১৯৪৯ সম্পাদনা

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, টিটো এর যুগোস্লাভ কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে যুগোস্লাভিয়া ফেডারেল রাষ্ট্র হিসাবে পুনর্গঠিত হয়েছিল। ১৯৪৪ সালে যখন পূর্বের ভারদার প্রদেশ পূনর্গঠন করা হয়, তখন তার বেশিরভাগ অঞ্চল পৃথক প্রজাতন্ত্রে স্থানান্তরিত হয় এবং প্রদেশের উত্তরাঞ্চলের অংশগুলি সার্বিয়ার সাথে থেকে যায়। ১৯৪৬ সালে, নতুন সোস্যালিস্ট ফেডারাল রিপাবলিক অব ইউগোস্লাভিয়ার অধীনে একটি স্বায়ত্বশাসিত "গণপ্রজাতন্ত্রী ম্যাসেডোনিয়া" নামে একে প্রজাতন্ত্র হিসেবে অনুমোদন দেয়া হয়। ১৯৬৩ সালে অন্যান্য ইউগোস্লাভ প্রজাতন্ত্রের সাথে মিল রেখে ইউগোস্লাভিয়া সংবিধানে সংশোধন করে একে সোস্যালিস্ট রিপাবলিক অব ম্যাসেডোনিয়া (সমাজতান্ত্রিক ম্যাসেডোনিয়া প্রজাতন্ত্র) নামে নামকরণ করা হয়।

সোস্যালিস্ট ফেডারাল রিপাবলিক অব ইউগোস্লাভিয়ার এর মানচিত্রের মধ্যে সমাজতান্ত্রিক ম্যাসেডোনিয়া প্রজাতন্ত্র কে লাল রঙ এ চিহ্নিত করা হয়েছে।

ইউগোস্লাভ সরকারের উদ্যোগে গ্রিস উদ্বিগ্ন ছিল, কারণ তারা মনে করেছিলো যে "উত্তর গ্রিস" নামে গ্রিক প্রদেশটির বিরুদ্ধে ভবিষ্যত আঞ্চলিক অভিযান পরিচালনার ক্ষেত্রে এটি একটি প্রাথমিক পদক্ষেপ। উত্তর গ্রিস প্রদেশটি ঐতিহাসিকভাবে পরিচিত ম্যাসেডোনিয়ার বৃহত্তর অংশ নিয়ে গঠিত ছিল এবং আনুষ্ঠানিকভাবে ম্যাসেডোনিয়া নামে পরিচিত ছিল। ইউগোস্লাভ কর্তৃপক্ষ ম্যাসেডোনিয়ানদের জাতিগত পরিচয় এবং ম্যাসেডোনিয়ান ভাষা উন্নয়নকে উতসাহিত করেছিল। ম্যাসেডোনিয়ান ভাষা ১৯৪৪ সালে (কিথ, ২০০৩) কোডেড করা হয়েছিল ভেলেসের কাছাকাছি প্রচলিত/কথিত স্লাভিক উপভাষা থেকে। এতে গ্রিস ও বুলগেরিয়া উভয়েই আরও অসন্তুষ্ট হয়েছিল। কারণ বলকান যুদ্ধের পরে প্রাপ্ত ম্যাসেডোনিয়ার গ্রিক ও বুলগেরিয়ান অংশে ইউগোস্লাভিয়ার সম্ভাব্য আগ্রাসনের আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল।

গ্রিক গৃহযুদ্ধের সময় (১৯৪৪-১৯৪৯) উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ম্যাসেডোনিয়ান জনগণ (জাতিবর্ন নির্বিশেষে) গ্রিক কমিউনিস্ট পার্টি পরিচালিত ইএলএএস প্রতিরোধ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিল। ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত ইএলএএস এবং ইউগোস্লাভিয়ার মধ্যে ভাল সম্পর্ক ছিল, কিন্তু জোসেফ স্ট্যালিনের (সিএফ. কমিনফর্ম ) প্রতি টিটোর আনুগত্যের অভাবের কারণে তাদের মধ্যে বিভক্তি তৈরী হয়। যুদ্ধ শেষে, ইএলএএস যোদ্ধারা যারা দক্ষিণ ইউগোস্লাভিয়া ও বুলগেরিয়ায় আশ্রয় নিয়েছিল তাদের সবাইকে গ্রিস নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার অনুমতি দেয়নি। শুধুমাত্র যারা নিজেদেরকে গ্রিক বলে মনে করত তাদের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল, আর যারা নিজেদেরকে বুলগেরিয়ান বা ম্যাসেডোনিয়ান বলে মনে করত তাদের নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। এই ঘটনাগুলি ম্যাসেডোনিয়াতে যুগোস্লাভ-গ্রিক খারাপ সম্পর্কের জন্য দায়ী।

প্রজাতন্ত্রের পথে সম্পাদনা

উত্তর ম্যাসেডোনিয়া

১৯৯০ সালে, সরকারের গঠনতন্ত্র শান্তিপূর্ণভাবে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা থেকে সংসদীয় গণতন্ত্র ব্যবস্থায় পরিবর্তীত হয়। নভেম্বর ১১, ২৫ এবং ডিসেম্বর ০৯, ১৯৯০ তারিখে প্রথম বহুদলীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। [২০] ভ্লাদিমির মিটকভ [২১] নেতৃত্বাধীন যৌথভাবে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের পর, ১৯৯১ সালের ৩১ শে জানুয়ারি কিরো গ্লিগোরভ ম্যাসেডোনিয়া প্রজাতন্ত্রের প্রথম গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি হিসেবে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন।[২২] ১৯৯১ সালের ১৬ই এপ্রিল, সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে নতুন পার্লামেন্ট দেশটির সরকারী নাম থেকে " সমাজতান্ত্রিক" শব্দটি অপসারণ করে। একই বছরের ৭ই জুন , ম্যাসেডোনিয়া প্রজাতন্ত্রের নতুন নাম আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়।

সেপ্টেম্বর ০৮, ১৯৯১ তারিখে ম্যাসেডোনিয়া প্রজাতন্ত্রে একটি গনভোট অনুষ্ঠিত হয় যেখানে ৯৫.২৬% জনগণ ম্যাসেডোনিয়া প্রজাতন্ত্রের নামে একটি পৃথক রাষ্ট্রের দাবীতে ইউগোস্লাভিয়া থেকে স্বাধীনতার জন্য ভোট দিয়েছিল। গণভোটের প্রশ্নটি গঠন করা হয়েছিল "আপনি কি ভবিষ্যতে ইউগোস্লাভিয়ার সার্বভৌম রাষ্ট্রগুলির সাথে জোটে অংশগ্রহণের অধিকার থাকবে এমন একটি স্বাধীন ম্যাসেডোনিয়া সমর্থন করেন?" (ম্যাসেডোনিয়ান: Дали сте за самостојна Македонија со право да стапи во иден сојуз на суверени држави на Југославија?)। ২৫শে সেপ্টেম্বর, ১৯৯১ তারিখে ম্যাসেডোনিয়া প্রজাতন্ত্রকে একটি স্বাধীন দেশ হিসাবে আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটি ম্যাসেডোনিয়ার সংসদে গৃহীত হয়, যদিও ম্যাসেডোনিয়াতে স্বাধীনতা দিবসটি এখনও গণভোটের অনুষ্ঠানের দিন হিসেবে ৮ই সেপ্টেম্বর তারিখে উদযাপন করা হয়। ১৭ই নভেম্বর ১৯৯১ তারিখে ম্যাসেডোনিয়া প্রজাতন্ত্রের একটি নতুন সংবিধান গৃহীত হয়।

বুলগেরিয়া সর্বপ্রথম সাংবিধানিক নামের অধীনে নতুন রাষ্ট্রটিকে স্বীকৃতি প্রদান করে। তবে, দেশটির হেলেনিক নাম, জাতীয় প্রতীক এবং প্রজাতন্ত্রের সংবিধানে কিছু বিতর্কিত ধারার জন্য গ্রিস আপত্তি করলে নতুন দেশটির আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়ায় বিলম্ব হয়েছিল। আপোস করার জন্য, ৮ এপ্রিল ১৯৯৩ তারিখে ম্যাসেডোনিয়া "ম্যাসেডোনিয়ার সাবেক ইউগোস্লাভ প্রজাতন্ত্র" এই অস্থায়ী নামে জাতিসংঘের সদস্যপদ গ্রহণ করে এবং অংশগ্রহণ করে। [২৩]

গ্রিস তখনও অসন্তুষ্ট ছিল এবং ফেব্রুয়ারি ১৯৯৪ সালে এটি ম্যাসেডোনিয়ার উপর বাণিজ্য অবরোধ আরোপ করে। ১৯৯৫ সালের সেপ্টেম্বরে ম্যাসেডোনিয়া দেশটির পতাকা এবং তার সংবিধানের কিছু ধারা পরিবর্তন করলে (যা অন্যান্য দেশগুলিতে হস্তক্ষেপ করার অধিকার হিসাবে বিবেচিত হয়েছিল) গ্রিস বাণিজ্য অবরোধ বাতিল করে। এতে দুই প্রতিবেশী দেশ অবিলম্বে তাদের সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে পদক্ষেপ নিতে পেরেছিল, কিন্তু রাষ্ট্রের নামটি এখনো স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বিতর্কের উৎস হিসাবে রয়ে গেছে।

"ম্যাসেডোনিয়ার সাবেক ইউগোস্লাভ প্রজাতন্ত্র" এই সাময়িক নামে জাতিসংঘের যোগ দেয়ার পর অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলি একই নামে তাদেরকে গ্রহণ করেছিল। যুক্তরাষ্ট্র সহ জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলির অর্ধেকেরও বেশি দেশ ম্যাসেডোনিয়া প্রজাতন্ত্র হিসেবে দেশটিকে স্বীকৃতি দিয়েছিল, বাকিরা "ম্যাসেডোনিয়ার সাবেক যুগোস্লাভ প্রজাতন্ত্র" এই সাময়িক নামটিকেই ব্যবহার করে অথবা ম্যাসেডোনিয়ার সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করা থেকে বিরত থাকে।

১৯৯৯ সালে, কসোভো যুদ্ধের ফলে কসোভো থেকে ৩৪০,০০০ আলবেনিয়ান শরণার্থী ম্যাসেডোনিয়াতে পালিয়ে এসে আশ্রয় গ্রহণ করার কারণে এ অঞ্চলে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হয় এবং ম্যাসেডোনিয়ান ও আলবেনিয়ানদের মধ্যে ভারসাম্য নষ্ট করার ব্যপারে হুমকি হয়ে উঠে। শরণার্থী ক্যাম্প সমূহ ম্যাসেডোনিয়াতে স্থাপন করা হয়েছিল। ইউগোস্লাভিয়ার সম্ভাব্য আক্রমণের আগে ন্যাটো বাহিনীর এই অঞ্চলে আগমন এবং পরবর্তীতে চলে যাওয়ার সময় এথেন্স কোন ধরনের হস্তক্ষেপ করেনি। থেসালোনিকি অঞ্চলে শরনার্থীদের মানবিক সাহায্যের প্রধান দপ্তর স্থাপিত হয়েছিল। ম্যাসেডোনিয়া প্রজাতন্ত্র এই যুদ্ধে জড়ানো থেকে বিরত থাকে।

যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরে ইউগোস্লাভ প্রেসিডেন্ট স্লবোদান মিলোশেভিচ এর সাথে ন্যাটোর চুক্তিতে পৌঁছানোর ফলে জাতিসংঘের তত্বাবধানে শরণার্থীরা নিজ দেশে ফিরে আসতে পেরেছিল। যাইহোক, কসোভো যুদ্ধ জাতিগত ম্যাসেডোনিয়ান এবং আলবেনিয় ম্যাসেডোনিয়ান মধ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধি করে এবং সম্পর্কের অবনতি ঘটায়। ইতিবাচক দিক হলো, এথেন্স ও আঙ্কারা এই বিরোধে জড়িত না থাকার ব্যপারে একমত ছিল। তবে গ্রীসে, ন্যাটো ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছিল।

২০০০-২০১০ সম্পাদনা

ম্যাকডোনাস্কা কামেনিকাতে ২০০১ সালে বিদ্রোহের সময় নিহত একজন ম্যাসেডোনিয়ান সৈনিকের স্মৃতিস্তম্ভ।

২০০১ সালের বসন্তে, জাতিগত আলবেনিয়ান বিদ্রোহীরা নিজেদেরকে জাতীয় মুক্তিবাহিনী (যাদের অনেকে কসোভো লিবারেশন আর্মি এর প্রাক্তন সদস্য ছিল) নামে অভিহিত করে এবং ম্যাসেডোনিয়া প্রজাতন্ত্রের পশ্চিম অঞ্চলে অস্ত্র তুলে নেয় । তাদের দাবি ছিল সংবিধানকে নতুন করে প্রণয়ন করতে হবে যেখানে জাতিগত আলবেনীয়দের ভাষার অধিকার এবং তাদের স্বার্থকে গুরুত্ব দিতে হবে। গেরিলারা ন্যাটো নিয়ন্ত্রিত কসোভোতে আলবেনীয়দের কাছ থেকে এবং কসোভো ও সার্বিয়ার মধ্যবর্তী অসামরিক এলাকায় জাতিগত আলবেনীয় গেরিলাদের কাছ থেকে সহযোগিতা পেয়েছিল। এই লড়াই শুধুমাত্র প্রজাতন্ত্রের পঞ্চম বৃহত্তম শহর টিটোভো এবং তার সংলগ্ন এলাকায় সীমাবদ্ধ ছিল।

কসোভোতে আলবেনিয়ান গেরিলাদের উপর ন্যাটো-সার্ব সেনাবাহিনীর যৌথ অভিযানের পর ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) কর্মকর্তারা ২০০১ সালের জুন মাসে একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি করতে সক্ষম হন। সরকার জাতিগত আলবেনিয়ানদের আরও বেশি নাগরিক অধিকার দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয় এবং গেরিলা গ্রুপ স্বেচ্ছায় তাদের অস্ত্রসমূহ ন্যটোর কাছে সমর্পন করে। এটি একটি সফল চুক্তি ছিল। আগস্ট ২০০১ সালে ন্যাটো ৩,৫০০ সৈন্য বাহিনী নিয়ে "অপারেশনস এসেনশিয়াল হার্ভেস্ট" নামে অস্ত্র উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করে। অভিযান সম্পন্ন হওয়ার পরপরই এনএলএ আনুষ্ঠানিকভাবে নিজেকে বিলুপ্ত করে। তার পর থেকে জাতিগত সম্পর্কগুলি উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নত হয়েছে, যদিও উভয় পক্ষের কট্টরপন্থীদের কারণে উদ্বেগ রয়ে গেছে এবং কিছু ছোটখাট সহিংসতা, বিশেষ করে পুলিশের বিরুদ্ধে, এখনও পরিচালিত হচ্ছে।

২৬ ফেব্রুয়ারি ২০০৪ তারিখে, বসনিয়া ও হার্জেগোভিনার একটি শহর মোস্তারের কাছে বিমান বিধ্বস্ত হয়ে রাষ্ট্রপতি বরিস ট্রাজকোস্কি মারা যান। সরকারী তদন্তের ফলাফলে দেখা গেছে যে মোস্তার বিমানবন্দরে অবতরনের সময় বিমানের কর্মীদের পদ্ধতিগত ভুলের কারণে বিমানটি দুর্ঘটনায় পতিত হয়েছিল।

২০০৪ সালের র্মাচ মাসে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন সদস্যপদের জন্য ম্যাসেডোনিয়া প্রজাতন্ত্র একটি আবেদন জমা দেয়। ডিসেম্বর ১৭, ২০০৫ তারিখে ইইউ প্রেসিডেন্সি ম্যাসেডোনিয়া প্রজাতন্ত্রকে আগ্রহী প্রার্থী হিসাবে তালিকাভুক্ত করে। এটা আশা করা হয়েছিল যে ২০০৬ সালের শেষের দিকে ইইউ এই বিষয়ে আলাপ আলোচনার তারিখ ঘোষণা দিবে।

২০০৫ সালের আগস্ট মাসে পোল্যান্ড জাতিসংঘের মোট ১৯১ টি সদস্যভুক্ত দেশ সমূহের মধ্যে ১১২ তম দেশ হিসেবে তৎকালীন সাংবিধানিক নাম "ম্যাসেডোনিয়া প্রজাতন্ত্র" কে স্বীকৃতি প্রদান করে। গ্রীস এবং ম্যাসেডোনিয়া প্রজাতন্ত্রের মধ্যে উক্ত প্রজাতন্ত্রের নামের বিষয়ে একটি স্থায়ী চুক্তি সম্পন্ন হওয়ার পূর্বে, 'রিপাবলিকা মেকেডোনিয়া-স্কোপেজ' (এই বানান দিয়ে) নামে দেশটির নামকরণ করার প্রস্তাব করা হয়েছিল, তবে তা ম্যাসেডোনিয়া প্রজাতন্ত্র দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হয়। জাতিসংঘের মধ্যস্থতাকারী ম্যাথু নিমিটজ কয়েক মাস পরে আরেকটি প্রস্তাব করেছিলেন, যেখানে বলা হয়েছিল যে যারা উক্ত রাষ্ট্রকে ইতিমধ্যে স্বীকৃতি দিয়েছে তারা "রেপাবলিকা ম্যাসেডোনিয়া" নামটি ব্যবহার করবে, গ্রিস 'রিপাবলিকা মেকেডোনিয়া -স্কোপেজ' নাম ব্যবহার করবে এবং আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা সমূহ ল্যাটিন বর্ণমালায় লেখা "রিপাবলিকা ম্যাকেডোনিয়া" নামটি ব্যবহার করবে, তবে এই প্রস্তাবটি গ্রিস প্রত্যাখ্যান করে।

২০১০ পরবর্তী সময় সম্পাদনা

২০১৮ সালের জুন মাসে, গ্রিস সরকার এবং ম্যাসেডোনিয়া প্রজাতন্ত্র এর সরকার প্রজাতন্ত্রটির নতুন নামকরণ করে উত্তর ম্যাসেডোনিয়া প্রজাতন্ত্র বা সংক্ষেপে উত্তর ম্যাসেডোনিয়া নামে পরিবর্তন করার ব্যপারে একমত হয় এবং চুক্তি স্বাক্ষর করে। এই চুক্তিটি উভয় দেশের সংশ্লিষ্ট আইন পরিষদের দ্বারা অনুমোদিত হওয়ার পর ফেব্রুয়ারি ১২, ২০১৯ তারিখ থেকে কার্যকর হয় এবং ফলশ্রুতিতে দীর্ঘদিনের বিরোধের পরিসমাপ্তি ঘটে।

আরও দেখুন সম্পাদনা

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

নোট সম্পাদনা

বহিঃসংযোগ সম্পাদনা

🔥 Top keywords: কৃষ্ণকুমার কুন্নথপ্রধান পাতাবিশেষ:অনুসন্ধান২০২৪ আইসিসি পুরুষ টি২০ বিশ্বকাপঘূর্ণিঝড় রেমালরবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকাজী নজরুল ইসলামশেখ মুজিবুর রহমানছয় দফা আন্দোলনবাংলাদেশবাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধভারতের সাধারণ নির্বাচন, ২০২৪আবহাওয়াক্লিওপেট্রাএক্স এক্স এক্স এক্স (অ্যালবাম)বাংলা ভাষা আন্দোলনকুরবানীফিলিস্তিনমৌলিক পদার্থের তালিকাস্বামী বিবেকানন্দমিয়া খলিফাপহেলা বৈশাখইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউনঘূর্ণিঝড়নাঈমুল ইসলাম খানবিশেষ:সাম্প্রতিক পরিবর্তনসমূহভূমি পরিমাপসুন্দরবনবাংলা প্রবাদ-প্রবচনের তালিকামহাত্মা গান্ধীপদ্মা সেতুলোকসভা কেন্দ্রের তালিকামুহাম্মাদঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরবিশ্ব দিবস তালিকাভারতসাইবার অপরাধইব্রাহিম (নবী)আসসালামু আলাইকুম