অরিহন্ত (জৈনধর্ম)

জৈনধর্মে অরিহন্ত (টেমপ্লেট:Lang-pka, সংস্কৃত: árhat "বিজয়ী") হলেন এমন এক জীব (আত্মা), যিনি আসক্তি, ক্রোধ, অহংকার ও লোভের মতো অনুভূতিকে জয় করেছেন। চারটি প্রতিকূল কর্মকে জয় করার পর তাঁরা শুদ্ধ আত্মাকে উপলব্ধি করেন।[১] কেবল জ্ঞানের (শুদ্ধ অনন্ত জ্ঞান) অধিকারী বলে অরিহন্তদের অপর নাম কেবলী (সর্বজ্ঞ সত্ত্বা)।[২][৩] অরিহন্তদের জিন (বিজয়ী) নামেও অভিহিত করা হয়। জীবনকাল সমাপ্ত হলে অরিহন্তেরা অবশিষ্ট কর্মগুলিকে ধ্বংস করে মোক্ষ লাভ করেন এবং সিদ্ধে পরিণত হন। অরিহন্তদের দেহ থাকে, কিন্তু সিদ্ধেরা দেহহীন শুদ্ধ আত্মা। জৈনধর্মে সম্মানিত পঞ্চ-পরমেষ্ঠির (পাঁচ সর্বোচ্চ সত্ত্বা) উদ্দেশ্যে উৎসর্গিত মূল প্রার্থনা ণমোকার মন্ত্র শুরুই হয়েছে ণমো অরিহন্তাণাং (অরিহন্তদিগকে প্রণাম) কথাটি দিয়ে।

বর্তমান কালচক্রের (অবসর্পিণী) প্রথম অরিহন্ত ঋষভনাথের ভাস্কর্যে কেবল জ্ঞান অর্জনের পর পদ্মের উপর তাঁর সঞ্চরণ

কথিত আছে, কেবলীগণ দুই শ্রেণিতে বিভক্ত:[২]

  1. তীর্থংকর কেবলী: চব্বিশ জন মানব ধর্মগুরু, যাঁরা কেবল জ্ঞান অর্জনের পরও মোক্ষের পথ শিক্ষা দেন।[৪]
  2. সামান্য কেবলী: যে কেবলীগণ শুধুমাত্র নিজের মোক্ষের কথাই চিন্তা করেন।

জৈনদের মতে, প্রত্যেক আত্মারই অরিহন্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। যে আত্মা অজ্ঞানতা প্রসারের কারণ ক্রোধ, অহং, প্রবঞ্চনা ও লোভের ন্যায় কাষায় বা অভ্যন্তরীণ শত্রু জয় করেছেন তিনিই অরিহন্ত হয়েছেন।[১]

দর্শন সম্পাদনা

জৈন ধর্মগ্রন্থগুলিতে বলা হয়েছে যে, চার প্রকার কর্ম ধ্বংস করতে পারলে সর্বজ্ঞতা অর্জন করা সম্ভব। ধর্মগ্রন্থে উল্লিখিত ক্রম অনুযায়ী এই চার প্রকার কর্ম হল যে কর্ম বিভ্রান্তির জন্ম দেয়, যে কর্ম জ্ঞানকে আড়াল করে রাখে, যে কর্ম উপলব্ধিকে আড়াল করে রাখে এবং যে ধর্ম বাধা সৃষ্টি করে।[৫] কথিত আছে, অরিহন্তেরা নিম্নোক্ত আঠারোটি ত্রুটি হতে মুক্ত:[৬]

  1. "জন্ম" (পুনর্জন্ম);
  2. "জরা" (বার্ধ্যক্য);
  3. "তৃষা" (তৃষা);
  4. "ক্ষুধা";
  5. "বিস্ময়";
  6. "অরাতি" (অসন্তোষ);
  7. "খেদ" (অনুশোচনা);
  8. "রোগ";
  9. "শোক";
  10. "মদ" (অহংকার);
  11. "মোহ" (মতিভ্রম);
  12. "ভয়";
  13. "নিদ্রা";
  14. "চিন্তা" (উদ্বেগ);
  15. "স্বেদ" (ঘর্মাক্ত অবস্থা);
  16. "রাগ" (আসক্তি);
  17. "দ্বেষ" (বিদ্বেষ); ও
  18. "মরণ" (মৃত্যু)।

সর্বজ্ঞতা সম্পাদনা

মহাবীরের কেবল জ্ঞান

জৈন মতে, সর্বজ্ঞতা হল অনন্ত এবং সর্বগ্রাহী জ্ঞান যা দর্পণের ন্যায় সকল বস্তু এবং অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ-ব্যাপী সেগুলির অনন্ত ধরনগুলিকে প্রতিফলিত করে।[৭] জৈন ধর্মগ্রন্থগুলি বলা হয়েছে যে, সর্বজ্ঞতা শুদ্ধ আত্মার স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য। সর্বজ্ঞতা-অর্জনকারী আত্মা কেবলী হয়ে থাকেন।

চারটি অনন্ততা ("অনন্ত চাতুষ্টয়") হল:[৬]

  1. "অনন্ত জ্ঞান" (অন্তহীন জ্ঞান),
  2. "অনন্ত দর্শন" (সকল "দর্শণাবরণীয়" কর্মের অস্তিত্ব বিনাশের ফলে প্রাপ্ত সঠিক ধারণা),
  3. "অনন্ত সুখ" (অনন্ত আনন্দ)
  4. "অনন্ত বীর্য" (অনন্ত শক্তি)

তীর্থংকর সম্পাদনা

বর্ধমান মহাবীর, বর্তমান কালচক্রের চতুর্বিংশ তথা শেষ তীর্থংকর
সমাবসরণ (দিব্য প্রচার সভাকক্ষ), সর্বজ্ঞ অরিহন্তগণ এখানে ধর্মপ্রচার করেন

যে অরিহন্তেরা জৈনধর্ম পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন, তাঁদের বলা হয় "তীর্থংকর"। তীর্থংকরগণ পুরুষ সন্ত ("সাধু"), নারী সন্ত ("সাধ্বী"), গৃহস্থ পুরুষ ("শ্রাবক") ও গৃহস্থ নারীর ("শ্রাবিকা") সমন্বয়ে গড়ে ওঠা সংঘকে পুনরুজ্জীবিত করেন। ঋষভনাথকে বর্তমান কালচক্রের প্রথম তীর্থংকর এবং মহাবীরকে (খ্রিস্টপূর্ব ৫৯৯ – ৫২৭ অব্দ) চতুর্বিংশ তথা সর্বশেষ তীর্থংকর মনে করা হয়।

জৈন ধর্মগ্রন্থগুলিতে অরিহন্ত বা তীর্থংকরদের ছেচল্লিশটি গুণের কথা বলা হয়েছে। এগুলির মধ্যে চারটি অপরিমেয়তা ("অনন্ত চতুষ্টয়"), চৌত্রিশটি অলৌকিক ঘটনা ("অতিশয়") এবং আটটি চমৎকারিত্ব ("প্রাতিহার্য")।[৬]

আটটি প্রাতিহার্য হল:[৮]

  1. "অশোকবৃক্ষ" – অশোক গাছ;
  2. "সিংহাসন" – রত্নখচিত সিংহাসন;
  3. "ছত্র" – three-tier canopy;
  4. "ভামদল" – অতুলনীয় ঔজ্জ্বল্যসম্পন্ন জ্যোতিশ্চক্;
  5. "দিব্য ধ্বনি" – ওষ্ঠসঞ্চালন ব্যতিরেকে প্রভুর দিব্য কণ্ঠস্বর;
  6. "পুষ্পবর্ষা" – সুগন্ধী পুষ্পের বৃষ্টি;
  7. "চামর" – চৌষট্টিটি রাজকীয় হাতপাখার সঞ্চালন; এবং
  8. "দুন্দুভি" – ঢোলক ও অন্যান্য বাদ্যযন্ত্রের সুমধুর ধ্বনি।

নির্বাণ সম্পাদনা

নির্বাণের (শেষ মুক্তি) সময় অরিহন্তেরা অবশিষ্ট চারটি "অঘাতি কর্ম" (যে কর্মগুলি আত্মার সত্য প্রকৃতিকে প্রভাবিত করে না) সমাপ্ত করে দেন:

  1. "নাম" (শারীরিক আকারদানকারী) কর্ম,
  2. "গোত্র" (মর্যাদা গঠনকারী) কর্ম,
  3. "বেদনীয়" (আনন্দ ও বেদনার কারণস্বরূপ) কর্ম,
  4. আয়ুষ্য (পরমায়ু নির্ধারণকারী) কর্ম।

পূজা সম্পাদনা

উদয়গিরি গুহাসমূহে রাজা খারবেলের হাতিগুম্ফা শিলালিপির প্রারম্ভে ণমোকার মন্ত্রের অবতারণা, খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দী।

ণমোকার মন্ত্রে (নমো অরিহন্তানাম্, নমো সিদ্ধানাম্) জৈনরা প্রথমে অরিহন্তদের ও পরে সিদ্ধদের প্রণাম জানান। কারণ সিদ্ধদের সকল কর্মবন্ধন-ক্ষয়কারী সিদ্ধ আত্মা হলেও অরিহন্তদের তাঁদের তুলনায় উচ্চ আধ্যাত্মিক স্থানের অধিকারী জ্ঞান করা হয়। সিদ্ধরা যেহেতু সর্বোচ্চ মুক্তি লাভ করেছেন, তাই সম্ভবত তাঁদের সঙ্গে সরাসরি সংযোগ সাধন সম্ভব নয়, শুধুমাত্র যে প্রজ্ঞার মধ্যে দিয়ে তাঁরা গিয়েছেন, তার মাধ্যমেই সম্ভব। অন্যদিকে আধ্যাত্মিক পথনির্দেশ পাওয়ার জন্য মানব সমাজ নির্বাণ পর্যন্ত অরিহন্তদের সাহায্য পেতে পারে। দ্রব্যসংগ্রহ নামে একটি প্রধান জৈন গ্রন্থে বলা হয়েছে:

চারটি ঘাতীয় কর্ম (অহিতকর কর্ম) নাশকারী, অনন্ত বিশ্বাস, আনন্দ, জ্ঞান ও শক্তির অধিকারী হয়েছে এবং পরমৌদারিক শরীর-এ (সর্বাধিক মঙ্গলময় শরীর) স্থিত, সেই বিশ্বশিক্ষকের (অরিহন্ত) সেই শুদ্ধ আত্মাকে ধ্যান করা উচিত।

— দ্রব্যসংগ্রহ, ৫০[৯]

আরও দেখুন সম্পাদনা

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. Sangave 2001, পৃ. 15।
  2. Sangave 2001, পৃ. 16।
  3. Sangave 2001, পৃ. 164।
  4. Rankin 2013, পৃ. 40।
  5. Jain, S.A. (১৯৬০)। Reality। Vira Sasana Sangha। পৃষ্ঠা 282। Non-Copyright 
  6. Jain 2014, পৃ. 3।
  7. Jain 2014, পৃ. 2।
  8. Jain 2013, পৃ. 181।
  9. Jain 2013, পৃ. 177।

সূত্রনির্দেশ সম্পাদনা

বহিঃসংযোগ সম্পাদনা

🔥 Top keywords: প্রধান পাতাবিশেষ:অনুসন্ধানছয় দফা আন্দোলনভারতের সাধারণ নির্বাচন, ২০২৪২০২৪ আইসিসি পুরুষ টি২০ বিশ্বকাপরবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকাজী নজরুল ইসলামভারতের প্রধানমন্ত্রীদের তালিকাবাংলাদেশশেখ মুজিবুর রহমানভারতের প্রধানমন্ত্রীনরেন্দ্র মোদীক্লিওপেট্রাভারতীয় জনতা পার্টিবাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধলোকসভাএক্স এক্স এক্স এক্স (অ্যালবাম)বাংলা প্রবাদ-প্রবচনের তালিকাইন্দিরা গান্ধীআবুল হাসান মাহমুদ আলীমহাত্মা গান্ধীআবহাওয়ারাহুল গান্ধীভারতভারতের রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলসমূহমমতা বন্দ্যোপাধ্যায়বিশ্ব পরিবেশ দিবসকুরবানীইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউনবাংলা ভাষা আন্দোলনভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসমিয়া খলিফাভূমি পরিমাপপশ্চিমবঙ্গবাংলা বাগধারার তালিকা২০২৪ কোপা আমেরিকাবেনজীর আহমেদরিশতা লাবণী সীমানামুহাম্মাদ